মিয়া আবদুল হান্নান : শাপলা ফুল বিক্রী করে জীবিকা নির্বাহ করছে শতশত গরীব অসহায় মানুষ গুলো। ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলা, নবাবগঞ্জ উপজেলা ও দোহার উপজেলা, সাভার খাল- বিল, নদী-নালা ডোবা গুলোতে লক্ষ লক্ষ শাপলা রাতে চাঁদের আলো জ্বলজ্বল করছে, ভোরবেলা সূর্য উদয়ের সাথে সাথে শাপলা তুলতে ছোট ছোট কুষা নৌকা নিয়ে খালে- বিলে শাপলা তুলতে দেখা যায় শত-শত নারী-পুরুষ ও তাঁদের সন্তানেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শাপলা ফুল তুলে ছোট ছোট আটি বেধে হাট বাজারে নিয়ে পাইকারি খুচরা বিক্রী করে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের সংসারের অভাব দূর করেছে। শাপলা ফুলের মাধ্যমে অন্যান্য সবজি চাহিদা অনেকটাই পূরণ হয়েছে। চিংড়ি মাছ ও ইলিশ মাছের শাপলার সবজির মজা স্বাদ গ্রহনই আলাদা। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের লাল শাপলার বিল পিপাসা মেটাচ্ছে প্রকৃতি প্রেমীদের। রাজধানীর কাছাকাছি হওয়ায় নগর জীবনকে কিছুটা স্বস্তি দিতে হাপিয়ে ওঠা মানুষ প্রতিদিনই ছুটে যাচ্ছেন সেখানে। হেমন্তের প্রকৃতি আরও মোহনীয় করে তুলেছে লাল শাপলার লাবণ্য। এ যেন বাংলা মায়ের আঁচলে জীবন্ত হয়ে ওঠা নকশি কাঁথার রঙিন মাঠ। দিগন্ত জুড়ে ফুটে আছে লাল শাপলা। সবুজ আর লালে তাই ভোরের জলজ গানে উড়াল দেয় পাখি ও মানুষের মন। শাপলার লাবণ্য ছুতেঁ জলের সাথে মিতালী দর্শনার্থীদের। শুধু লাল শাপলা আর পদ্মই না, এই বিল মুখরিত হয় পাখির গুঞ্জরনে। শালিক, দোয়েল, ফিঙেরাজাসহ অনেক দেশীয় পাখির কলতান মোহময়তা বাড়িয়েছে অপার সৌন্দর্যের। শাপলার বুকে বসে থাকা রঙির ফড়িং কিংবা দোয়েলের গান আপনার চিত্তে দোলা দিবেই। বছরের ৪/৫ মাসই এমন সৌন্দর্য্য নিয়ে ফুটে থাকে লাল শাপলার বিল।কলারোয়া উপজেলার বিভিন্ন খাল-বিলে বর্ষা মৌসুমে ফোটে বিভিন্ন প্রজাতির শাপলা। এর মধ্যে নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর লাল শাপলার প্রতি আকর্ষণ সব চেয়ে বেশী। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে এ ফুল ফোটা শুরু হয়ে প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত বিল-ঝিল জলাশয় ও নিচু জমিতে প্রাকৃতিক ভাবেই জন্ম নেয় নানা প্রজাতির শাপলা। এটি একটি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। আবহমান কাল থেকে শাপলা মানুষের খাদ্য তালিকায় সবজি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাসাইলের লক্ষীখোলার বিল, বেড়ির বিল, কুশোডাঙ্গার বিল, ছলিমপুরের বিল, রায়টার বিল এ অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষেরা এক সময় শাপলা বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করতো বলে শোনা যায়। সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রঙ্গের শাপলা ঔষধি গুন সমৃদ্ধ। ছোটদের কাছে শাপলা ফুল অনন্য সৌন্দর্যের একটি প্রিয় খেলনা। বর্ষার শুরুতে শাপলার জন্ম হলেও হেমন্তের শিশির ভেজা রোদ মাখা সকালের জলাশয়ে চোখ পড়লে রং-বেরঙের শাপলার বাহারি রূপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। এ যেন সাজানো ফুল বাগানের মধ্যে শ্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এমন দৃশ্য চোখে না দেখলে কারও বোধগম্য হবে না। বর্ষা মৌসুমে নৌকা নিয়ে সৌন্দর্য মন্ডিত এ দৃশ্য অবলোকন করতে ছুটে আসতেন প্রকৃতি প্রেমীরা। আবার নিম্ন আয়ের লোকেরা শাপলা বিক্রি করে জীবিকাও নির্বাহ করতো। স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য হওয়ায় কারণে এলাকার লোকজন শাপলা তুলে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। এছাড়া এসময় সবজির দর চড়া থাকার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতো। শহরের এক শ্রেণীর মানুষের কাছে মৌসুমি এ সবজির একটি প্রিয় খাদ্য। বর্তমান সভ্যতায় বাড়তি জনসংখ্যার চাপে আবাদী জমি ভরাট করে বাড়ি, পুকুর, রাস্তাঘাট, মাছের ঘের বানানোর ফলে বিলের পরিমাণ যেমন কমছে, তেমনি শাপলা জন্মানোর জায়গাও কমে আসছে।
এছাড়া প্রভাবশালী, জবর-দখলকারী শ্রেণীর লোক খাল-বিলের জায়গা দখল করে নিজেদের আয়ত্তে নেওয়ার কারণে অনেক বিলের জায়গাই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষাবাদের কারণে অধিক মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, খাল-বিল ও জলাশয় ভরাটের কারণে উপজেলার বিভিন্ন বিলাঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে নানা জাতের শাপলা। এখন খাল-বিল ও জলাশয় থেকে প্রায় হারিয়েই যাচ্ছে শাপলা। এক সময় সৌখিন মানুষেরা সৌন্দর্যের জন্য নিজের পুকুরে শাপলা চাষ করতো। এখন ওই সকল পুকুরে কার্প জাতীয় মাছ যেমন- সিলভার কার্প, রোবোকার্প, গ্রাস কার্প মাছ চাষের ফলে শাপলার বংশ বিস্তার সমূলে বিনাশ হয়ে যাচ্ছে। সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রংয়ের শাপলা ঔষধি কাজে ব্যবহৃত হয়। শাপলা খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি। সাধারণ শাক-সবজির চেয়ে এর পুষ্টিগুন অনেক বেশি। শাপলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমাণ আলুর চেয়ে সাতগুন বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, শাপলা চুলকানী ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী। তাছাড়া ডায়াবেটিস, বুক জ্বালা, লিভার, ইউরিনের সমস্যার সমাধানসহ নারীদের মাসিক নিয়ন্ত্রনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঐতিহাসিক কাল থেকেই শাপলার ফল (ঢ্যাপ) দিয়ে চমৎকার সুস্বাদু খৈ ভাজা হতো। যেটি গ্রামগঞ্জে ঢ্যাপের খৈ হিসেবে পরিচিত। মাটির নিচের মূল অংশকে (রাইজোম) আঞ্চলিক ভাষায় শালুক বলে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বিল-ঝিল-হাওড়-বাঁওড়-পুকুরের পানি যখন কমে যায় তখন শালুক তুলে খাওয়া হত, তা খেতেও বেশ সুস্বাদু। তবে আমাশয়ের জন্য এটি খুবই উপকারী। কলারোয়া উপজেলার পিছলাপোল গ্রামের আঃ কাদের জানান, কয়েক বছর আগেও বর্ষা কাল থেকে শরৎকালের শেষ ভাগ পর্যন্ত বিল এলাকায় মাইলের পর মাইল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকত নয়নাভিরাম নানা প্রজাতির শাপলা। এখন আর এমন দৃশ্য চোখে পড়ে না।
অনেকের কাছে শাপলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা সৃষ্টিকর্তার অপার সৃষ্টি মনে করলেও বিল ঘেঁষা জমি মালিকদের কাছে এটা নিতান্তই বিরক্তিকর বিষয় বলে দাবী করেন কৃষক আলমগীর হোসেন আবু বকর ও বাবলুর রহমান। তারা বলেন, বোরো মৌসুমের আগে জমিতে চাষাবাদের জন্য এই শাপলার কারণে জমি পরিষ্কার করতে তাদের গুনতে হয় অতিরিক্ত অর্থ। ভাল চাষ না করতে পারলে জমিতে ফলনও কম পাওয়া যায়। কলারোয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা জানান, বর্ষা শেষ না হতেই খাল-বিল ও আবদ্ধ জলাশয়গুলো শুকিয়ে যাওয়ার ফলে শাপলা জন্মানোর ক্ষেত্র বিনষ্ট হয়ে পড়েছে। এর ফলে প্রাকৃতিক এ জাতীয় ফুলটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। সরকারি উদ্যোগে এর অনুকূল পরিবেশ তৈরি প্রয়োজন।
|