মিয়া আবদুল হান্নান : বাংলাদেশে কাজ করছে পাঁচ লাখের বেশি বিদেশিকর্মী : ঘাটতি হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রফতানি করলেও এদেশেই কাজ করছেন বিপুল সংখ্যক বিদেশিকর্মী। সরকারি হিসেবে সেটি এক লাখ বলা হলেও এটির প্রকৃত সংখ্যা পাঁচ লাখের বেশি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। দুই বছর আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ২১টি খাতে ৪৪টি দেশের আড়াই লাখ কর্মী কাজ করছেন। যারা বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর নিয়ে যাচ্ছেন ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী ও জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগি, দক্ষতা ভিত্তিক না হওয়ার কারণে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হলেও শিল্প প্রতিষ্ঠানে যে রকম দক্ষকর্মী প্রয়োজন সেটির চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। কারিগরি শিক্ষার দক্ষতার অভাবে বহিঃবিশ্বের বাজারেও অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ফলে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই অদক্ষ শ্রমিক। আগামী দিনে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, প্রযুক্তি, রোবটিক ও আইওটির (ইন্টারনেট অব থিংস) যুগে টিকে থাকতে হলে সকল জনশক্তিকে কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার তাগিদ দিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র, শিক্ষা, শ্রম ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।গোটা বিশ্বই এখন প্রস্তুত হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য। কারণ প্রযুক্তির এই বিপ্লবে বিপ্লব ঘটবে মানুষের জীবনমান, পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত হবে শিল্প, অর্থনীতি, যোগাযোগ। সবকিছুর কেন্দ্রে থাকবে মেশিন, রোবট, ইন্টারনেট অব থিংক (আইওটি)সহ প্রযুক্তির নতুন নতুন সব উদ্ভাবন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ জনশক্তির চাহিদাও বাড়ছে দিনে দিনে। এজন্য প্রযুক্তির এসব উদ্ভাবন ও পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে উন্নত দেশগুলো উন্নত যুগোপযোগী শিক্ষায়, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। জার্মানিতে ৭৩, জাপানে ৬৬, সিঙ্গাপুরে ৬৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০, চীনে ৫৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০ শতাংশ মানুষ কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ। সব উন্নত দেশে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলামও তৈরি করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা যতটা এগুচ্ছে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে ততটাই। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিদিনই দক্ষ কর্মীর চাহিদা বাড়লেও কেবল প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশ এই বাজার ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করেন তারা। পিছিয়ে পড়ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও নেপাল থেকেও। যদিও প্রতি বছরই ৬ থেকে ৮ লাখ জনশক্তি রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মাধ্যমও তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সই।
শিক্ষাবিদ ও জনশক্তি রপ্তানিকারকরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের যদি প্রয়োজনভিত্তিক, দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা দেয়া যায় এবং যারা বিদেশের শ্রমবাজারে যাচ্ছেন তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলা যায় তাহলে এই চিত্র পরিবর্তন হতে পারে। এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. এ বি এম রাশেদুল হাসান বলেন, এখন আর গতানুগতিক ধারার শিক্ষায় কিছু হবে না। আমাদের নজর দিতে হবে বিশ্ব কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে, কি ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে, কেমন দক্ষতা প্রয়োজন? কারণ এখনই মেশিন হিউম্যান রিসোর্সের জায়গা নিচ্ছে। তিনি বলেন, প্রযুক্তির কল্যাণে সামনের দিনে যে চ্যালেঞ্জ আসছে সেটিকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন হবে কারিগরি শিক্ষা, কম্পিউটারের দক্ষতা। এর কোনো বিকল্প নেই।পার্শ্ববর্তী দেশের উদাহরণ দিয়ে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ভারত তাদের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউশন ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দেয়ার কারণে এখন তারা এই ক্ষেত্রে এগিয়েছে, অনেক জায়গায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের ভুড়ি ভুড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো দরকার নেই। কৃষিতে, শিল্পে যেরকম প্রয়োজন, তেমন দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের তথ্যমতে, কারিগরি শিক্ষার হার প্রায় ২০ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্য মতে, প্রতিবছর কয়েক লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। যাদের বেশিরভাগই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। ফলে প্রশাসনিক পদে থাকছে বিপুল প্রতিযোগিতা থাকলেও কর্মক্ষেত্রে যে ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন সেটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে না থাকায় বিভিন্ন কর্পোরেট সেক্টর ও বেসরকারি সংস্থাকে বিদেশ থেকে লোক আনতে হচ্ছে।
জানা যায়, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেলেও দেশে ভালো চাকরির নিশ্চয়তা নেই। উচ্চশিক্ষায় দুর্দান্ত ফল অর্জনকারীদের মধ্যে ২ থেকে সাড়ে ৩৪ শতাংশ বেকার। আবার যারা চাকরি পান, তাদের ৭৫ শতাংশেরই বেতন চল্লিশ হাজার টাকার নিচে। উচ্চশিক্ষিত মেধাবীদের চাকরি, বেতন ও বেকারত্বের এ হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক গবেষণায়। ওই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, শিক্ষিতদের (এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী) এক-তৃতীয়াংশই বেকার। তাদের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার বেশি অর্থাৎ যাদের পেছনে দেশ ও পরিবার বেশি অর্থ ব্যয় করেছে, তারাই বেশি বেকার। বিআইডিএসের গবেষণা অনুযায়ী, সার্বিকভাবে শিক্ষিতদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের বেশি বেকার। আর এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যারা প্রথম শ্রেণি পেয়েছে, তাদের মধ্যে বেকারত্ব ১৯ থেকে সাড়ে ৩৪ শতাংশ। বিশেষ করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশই বেকার। স্নাতক পর্যায়ে এমন মেধাবীদের বেকারত্বের হার প্রায় ২৮ শতাংশ।সাধারণ শিক্ষার্থীদের কর্মবাজারের উপযোগী কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কর্মবাজারের উপযোগী করতে কারিগরি শিক্ষাকে সুলভ ও আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করছে সরকার।
|