আব্দুল্যাহ আল মামুন
এ অঞ্চলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয় ১৯১৯ সালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলে। তবে তখন প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পৌর এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৩০ সালে বেঙ্গল (রুরাল) প্রাইমারি এডুকেশন অ্যাক্ট প্রণয়নের মধ্য দিয়ে গ্রাম অঞ্চলের ৬ থেকে ১১ বছরের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা লাভের সুযোগ তৈরি হয়। এরপর ১৯৫১ সালে ব্রিটিশ-উত্তর পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদে পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প গৃহীত হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট কর্তৃক উত্থাপিত ২১ দফার মধ্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিশ্রুতির ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৯ সালের জাতীয় শিক্ষা কমিশন ১০ বছরের মধ্যে পাঁচ বছরমেয়াদি এবং ১৫ বছরের মধ্যে আট বছরমেয়াদি বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করে। উল্লিখিত কিছু পদক্ষেপ ছাড়া স্বাধীনতা-পূর্বকালে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা খাত ছিল একেবারেই অবহেলিত।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে রচিত ১৯৭২ সালের সংবিধানে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে স্থান দেওয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনা করেই বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন। ১৯৭৩ সালে একযোগে ৩৬ হাজার ১৬৫ প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রযাত্রার সূচনা করেন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গঠিত ‘কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন’ প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করার সুপারিশ করে। বঙ্গবন্ধুর গৃহীত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপগুলোর ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ প্রণীত হয়। ওই শিক্ষানীতিতে বলা হয়, ‘প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক এবং সবার জন্য একই মানের।’ এ নীতিতে শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং শিক্ষার উন্নয়নে করণীয় ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ আছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নে এবং প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের গৃহীত আরও পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে চার দফার প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন কর্মসূচির গ্রহণ। বছরের প্রথম দিনে শিশু শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া এ কর্মসূচির আওতায় অসাধারণ উদ্যোগ। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সব শিক্ষার্থীকে বছরের প্রথম দিনে পাঠ্যবই বিতরণ পৃথিবীতে নজিরবিহীন। এ কর্মসূচির অন্য উদ্যোগগুলো হলো শতভাগ উপবৃত্তি কার্যক্রম, অনগ্রসর এলাকায় স্কুল ফিডিং চালু, সরকারি বিদ্যালয়ে দপ্তরি-কাম-নৈশপ্রহরী নিয়োগ, খুদে ডাক্তার, স্টুডেন্ট কাউন্সিল গঠন, ই-মনিটরিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যালয় পরিদর্শন ইত্যাদি। উপবৃত্তির অর্থ ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের মোবাইল ফোনে সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছে। শিশু শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার মাধ্যমে মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ঘটাতে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালু ও সব বিদ্যালয়ে সুসজ্জিত প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষ প্রস্তুত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে একজন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকের নতুন পদ সৃষ্টিসহ প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ ও পুল শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বাড়তি ৩৭ হাজার ৭২৬ সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাইজেশন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করা, ঝরে পড়ার হার প্রায় শূন্যের কোটায় নিয়ে আসা, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সমতা আনা, নতুন শিক্ষাক্রমে নতুন পাঠ্যবই ছাপানো, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চালু, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ নানা ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে। প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (পিইডিপি-৪), জিপিএস, এনএনজিপিএস প্রজেক্টের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নতুন ভবন, ওয়াশ ব্লক, বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ, আসবাব ক্রয়, নিরাপদ খাবার পানির উৎস স্থাপনসহ ব্যাপক ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে স্কুল লেভেল ইম্প্রুভমেন্ট প্ল্যান (স্লিপ), প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার উপকরণ ও শ্রেণিকক্ষ সজ্জিতকরণ, বিদ্যালয়ের মেইনটেন্যান্স ও কন্টিজেন্সি বাবদ এবং স্কিমের আওতায় সরকারি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। সরকার ডিজিটাল কন্টেন্টের মাধ্যমে আনন্দঘন শিক্ষণ ব্যবস্থা চালুর জন্য বিদ্যালয়গুলোতে আইসিটি সামগ্রী হিসেবে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দেওয়া এবং শিক্ষকদের আইসিটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিটি উপজেলায় একটি করে বিদ্যালয়ে ওয়েল ইকুইপড ডিজিটাল স্মার্ট ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে।
শিক্ষার উন্নয়নে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা সবার ওপরে। ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি বর্তমান সরকার শিক্ষার মানোন্নয়নে যে কয়েকটি অসাধারণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এর একটি হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদটি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীতকরণ। সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেলও একধাপ উন্নীত করা হয়। বর্তমানে প্রধান শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১১ এবং সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১৩। এ ছাড়া ৩৪তম বিসিএস চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যারা ক্যাডার পাননি, তাদের মধ্য থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দ্বিতীয় শ্রেণির নন-ক্যাডার পদমর্যাদায় নিয়োগ করা হয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং গুণগত শিক্ষার ধারা নিশ্চিত করতে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে সরকার পর্যায়ক্রমে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। সম্প্রতি নতুন করে ৩৭ হাজার ৫৭৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকসহ আগের বেশিরভাগ শিক্ষকের স্নাতক বা তদূর্ধ্ব ডিগ্রি রয়েছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের মানও এরই মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষকদের পর্যায়ক্রমে দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, নিড বেজড সাব-ক্লাস্টার প্রশিক্ষণ, আইসিটি প্রশিক্ষণ, প্রধান শিক্ষকদের লিডারশিপ প্রশিক্ষণ ও ইংরেজি বিষয়ে দক্ষ করতে সরকারি অর্থায়নে ব্রিটিশ কাউন্সিল কর্তৃক মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষণসহ নানাবিধ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বিদ্যালয় পরিদর্শনকারী কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
রূপকল্প ২০৪১, স্মার্ট বাংলাদেশ এবং জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) বাস্তবায়নের জন্য মানবসম্পদ উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’-এর প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব শিশুর মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, যা অর্জনে বাংলাদেশ দৃঢ় অঙ্গীকার করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি ভিত্তির অন্যতম ভিত্তি ‘স্মার্ট নাগরিক’ তৈরির জন্যও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ও চিকিৎসার পাশাপাশি শিক্ষাকে মৌলিক প্রয়োজন হিসেবে স্বীকৃত দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, রূপকল্প ২০৪১, স্মার্ট বাংলাদেশ ও এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে সরকার উপর্যুক্ত যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছে। তথাপি, প্রাথমিক শিক্ষার সুষম উন্নয়নে কিছু অন্তরায় এখনো বিদ্যমান। সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে শিক্ষকদের আন্তরিকতা বাড়াতে এবং পেশাদারিত্বের মনোভাব তৈরি করতে হবে। শিক্ষকতাকে শুধু পেশা নয়, ব্রত হিসেবে গ্রহণ করলে সেই শিক্ষক কর্তৃক পুরো জাতি উপকৃত হবে। শিক্ষকদের পাঠাভ্যাসের অনীহা দূর করা প্রয়োজন। পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষা উপকরণ ও ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবহার করে শ্রেণি পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষকদের কার্যকর যোগাযোগের অভাব রয়েছে। পরিদর্শনে দেখা যায়, একজন শিক্ষক বাড়ির নিকটতম একই বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত আছেন এবং ব্যবসাসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকছেন। ফলে তিনি শিক্ষকতায় পরিপূর্ণভাবে মনোনিবেশ করতে পারছেন না। এ ছাড়া শিক্ষকদের পাঠদানের বাইরে অন্য কাজে সম্পৃক্ত করা থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিরত থাকতে হবে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাণিজ্যিকীকরণ মুক্ত করার মতো জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব প্রয়োজন। অভিভাবকদের অসচেতনতা, নিরক্ষরতা ও আর্থসামাজিক অবস্থা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের অন্যতম অন্তরায়। পিছিয়ে পড়া ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল প্রান্তিক পরিবারের শিশুদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও সচেতন থাকা প্রয়োজন। বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক গোষ্ঠী, অঞ্চল, জাতি, লিঙ্গ ও স্বাস্থ্যগত অবস্থানের সব শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বোপরি, উল্লিখিত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সরকার কর্তৃক গৃহীত নীতি ও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সবার জন্য একই মানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে সব অংশীজনের সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন।
লেখক: যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহাম থেকে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ে মাস্টার্স
|