মিয়া আবদুল হান্নান : আত্মত্যাগের মহিমা। এক বেদনাবিধুর ও শোকবিহ্বল ঘটনার মুসলিম মিল্লাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক দৃশ্যটি রচিত হয় কারবালা প্রান্তরে, কারবালা প্রদেশ ইরাকের একটি প্রদেশ। এর রাজধানী কারবালা শহর। কারবালা শিয়া মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের একটি পবিত্র তীর্থস্থান। এখানে শিয়াদের অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ইমাম হুসেনের সমাধি অবস্থিত। শিয়া মুসলিমেরা ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে দলে দলে এখানে তীর্থে আসেন। ৬১ হিজরির ১০ মহররম আংশিক ঘটনাবলী। আজ শনিবার ৬ মহররম১৪৪৬ হিজরি,১৩ জুলাই। ১০ মহররমের এদিন শাহাদতবরণ করেন হযরত মুহাম্মদ রাসুলে করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাতি হজরত হোসাইন (রা.)। তার শাহাদতবরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় অন্যায়ের প্রতিবাদ ও ন্যায়ের আদর্শের জন্য আত্মত্যাগের মহিমা। এ বেদনাবিধুর ও শোকবিহ্বল ঘটনার প্রেক্ষাপট রচিত হয় ধীরে ধীরে, একটু একটু করে।
হজরত মুয়াবিয়া (রা.) তার পরবর্তী খলিফা হিসাবে নিজের ছেলে ইয়াজিদকে মনোনীত করেন। এ মনোনয়নে সাহাবিরা সন্তুষ্ট হননি। তবে সাহাবিরা যখন দেখলেন হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর প্রচেষ্টায় বড় একটি অংশ ইয়াজিদের বায়াত গ্রহণ করেছে, তখন তারা মুসলমানদের পারস্পরিক বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতা থেকে রক্ষা করার জন্য বাধ্য হয়ে ইয়াজিদের বায়াত মেনে নেন। কিন্তু মদিনাবাসী, বিশেষ করে হযরত হোসাইন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) এ বায়াত মেনে নিতে পারেননি। অন্তিম শয্যায় হযরত মুয়াবিয়া ইয়াজিদকে বলে যান, ‘আমার মনে হচ্ছে ইরাকবাসী হযরত হোসাইনকে তোমার বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করবে।
যদি এমন হয়-ই, তুমিও যদি তার মোকাবিলায় বিজয়ী হও, তাহলে হোসাইনকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে। আখেরী নবী রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর পরিবার-পরিজনকে সর্বদাই সম্মান প্রদর্শন করবে। সব মুসলমানদের ওপর তাদের অধিকার রয়েছে।’ হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর ইন্তেকালের পর খেলাফতের আসনে বসেন ইয়াজিদ। আসনে বসেই মদিনার গভর্নর ওয়ালিদ ইবনে উকবাকে হযরত হোসাইন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.)-এর ওপর বায়াতের জন্য চাপ সৃষ্টি করার নির্দেশ দেন। তিনি চেষ্টাও করেন। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে রাতারাতি মদিনা ত্যাগ করেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের এবং হযরত হোসাইন (রা.)। তারা গিয়ে ওঠেন মক্কায়। কুফাবাসীরা তখন হোসাইন (রা.)কে চিঠি লিখে জানালেন, ‘আমরা ইয়াজিদের হাতে বায়াত হতে রাজি নই। আপনি এ মুহূর্তে কুফায় চলে আসুন। আমরা সবাই আপনার হাতে বায়াত গ্রহণ করব।’ পরপর তারা একই মর্মের অনেকগুলো চিঠি পাঠায়। তাদের ক্রমাগত চিঠি দেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে তিনি তার চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় পাঠালেন এক ধরনের গোয়েন্দা হিসাবেই।কুফায় কিছুদিন অবস্থান করে ইবনে আকিল বুঝতে পারলেন, এখানের সাধারণ মুসলমানরা ইয়াজিদের হাতে বায়াত হতে মোটেই আগ্রহ নয় বরং হোসাইন (রা.)-এর হাতে বায়াত হতে আগ্রহী। তাই তিনি হোসাইন (রা.)-এর খেলাফতের ওপর বয়াত নেওয়া শুরু করলেন। অল্প ক’দিনেই কুফার আঠারো হাজার মুসলমান বায়াত গ্রহণ করল। পাশাপাশি তিনি চিঠি লিখে হযরত হোসাইন (রা.)কে আশ্বস্ত করে কুফায় আসার আহ্বান জানালেন। হোসাইন (রা.) কুফায় যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার পর অনেকেই তাকে কুফায় যেতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা করে ৬০ হিজরির ৩ অথবা ৮ জিলহজ মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশে রওনা হন। এদিকে ইয়াজিদের কয়েকজন সমর্থক তাকে জানাল, কুফার গভর্নর নুমান ইবনে বশির নবী পরিবার এবং তার সমর্থকদের প্রতি ক্ষাণিক দুর্বল। মুসলিম ইবনে আকিল হোসাইন (রা.)-এর হয়ে বায়াত নিয়ে যাচ্ছেন।’ তৎক্ষণাৎ আব্দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে কুফার নতুন গভর্নর নিয়োগ দিলেন ইয়াজিদ। কুফায় এসেই ইবনে জিয়াদ ঘোষণা করল, ‘যার ঘরে ইয়াজিদবিরোধী লোক পাওয়া যাবে, তাকে দরজার সামনেই শূলে চড়ানো হবে।’ শুধু তাই নয়, তার নির্দেশে মুসলিম ইবনে আকিলকে হত্যা করা হয়। ‘সায়ালাবিয়া’ পৌঁছে হোসাইন (রা.) খবর পেলেন মুসলিম ইবনে আকিলকে শহিদ করে দেওয়া হয়েছে। ‘যায়ালা’ পৌঁছে শুনতে পেলেন, ইবনে আকিলের কাছে পাঠানো তার দুধভাই আব্দুল্লাহ ইবনে লাকিতকেও হত্যা করা হয়েছে। হোসাইন (রা.) দেখলেন এতদিনের আশঙ্কাগুলো এখন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন কুফার পরিবেশ এখন তার সম্পূর্ণ প্রতিকূলে। তিনি তার সঙ্গীদের বললেন, ‘কুফাবাসী আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আমার অনুসারীরা আমার বায়াত থেকে ফিরে গেছে। এখন তোমরা চলে যেতে পার। কারও দায়িত্ব নিজের ওপর নিতে চাই না।’ এ ঘোষণার পর পথ থেকে যুক্ত হওয়া মানুষগুলো চলে গেল। হোসাইন (রা.)-এর সঙ্গে থেকে গেল কেবল তারাই, যারা তার সঙ্গে মক্কা থেকে এসেছে।
ইবনে জিয়াদ হোসাইন (রা.)-কে গ্রেফতার করার জন্য হুর ইবনে ইয়াজিদের নেতৃত্বে এক হাজার অশ্বারোহী পাঠাল। তারা এসে হোসাইন (রা.)-কে নিয়ে এলো কারবালার ময়দানে। এ ময়দানে চার হাজার সৈন্য নিয়ে হোসাইন (রা.)-এর সঙ্গে যুদ্ধ করতে এলো ওমর ইবনে সাদ।সে চাইত হোসাইন (রা.)-এর সঙ্গে যেন তার যুদ্ধ করতে না হয়। কিন্তু ইবনে জিয়াদ তাকে জোর করে পাঠিয়েছে। ওমর বিন সাদকে হোসাইন (রা.) তিনটি প্রস্তাব দিলেন। এক. আমি যেখান থেকে এসেছি, সেখানে ফিরে যাব। দুই. অথবা আমাকে ইয়াজিদের কাছে নিয়ে চলুন।
আমি তার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। তিন. অথবা আমাকে কোনো মুসলিম দেশের সীমান্তে পৌঁছে দিন। আমি সেখানের সাধারণ মুসলমানদের সঙ্গে বসবাস করব। প্রস্তাব তিনটি চিঠি লিখে ইবনে জিয়াদকে জানাল ওমর বিন সাদ। এ চিঠি ইবনে জিয়াদকে প্রভাবিত করল।
সে বলল, ‘এই চিঠি এমন এক ব্যক্তির, যিনি আমিরের অনুগত এবং নিজ কওমের কল্যাণকামী। আমি প্রস্তাব মঞ্জুর করলাম।’ কিন্তু সীমার কান পড়িয়ে তার মন ঘুরিয়ে দেয়। ইবনে জিয়াদ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। বলে দেন, হোসাইনি কাফেলাকে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দাও। তার সামনে এখন একটাই পথ, ইয়াজিদের হাতে বায়াত। ১০ মহররম ঘটে কারবালার মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। হোসাইন (রা.)-কে শহিদ করে দেওয়া হয়। তার মস্তক মোবারক কেটে নেওয়া হয়। তবে কে কেটেছে এই নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলে সিনান ইবনে আনাস। কেউ বলে সীমার মাথা কেটেছে। তার সঙ্গে সাহায্য করেছে সিনান ইবনে আনাস। হোসাইন (রা.)-এর মস্তক মোবারক পৌঁছানো হলো ইয়াজিদের সামনে। ইয়াজিদ তখন বললেন, ‘আমি তো নির্দেশ দিয়েছিলাম হত্যা না করে শুধু গ্রেফতার করবে। হত্যাকারী ধ্বংস হোক। আমি সেখানে থাকলে হোসাইনকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতাম। অসমাপ্ত।
|