মানিকগঞ্জের বাসস্ট্যান্ড এলাকাটি কেবল যাত্রীদের জন্য নয়, বরং শ্রমজীবী মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ প্রায় দেড় দশক ধরে এখানে গড়ে উঠেছে শ্রম বিক্রির একটি সরব বাজার, যা স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘শ্রমিকের হাট’ নামে। প্রতিদিন ভোরে এখানে কাজের সন্ধানে আসেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অসংখ্য দিনমজুর।
প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই বাসস্ট্যান্ড ওভারব্রিজের নিচে বাইতুল আমান জামে মসজিদের সামনে জড়ো হতে থাকেন শ্রমজীবী মানুষরা। কেউ গামছা বাঁধা মাথায় দাঁড়িয়ে থাকেন, কেউ বা হাতে বেলচা কিংবা বাঁশের ঝুড়ি নিয়ে অপেক্ষা করেন। সকাল আটটার মধ্যেই এই হাটের ব্যস্ততা চরমে পৌঁছায়। এরপর ধীরে ধীরে শ্রমিকদের সংখ্যা কমতে শুরু করে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এই শ্রমিকদের বেশিরভাগই মানিকগঞ্জের স্থানীয় হলেও পাবনা, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রম বিক্রি করতে আসেন। সাধারণত তারা কৃষিকাজে নিয়োজিত হন। দৈনিক মজুরি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। দক্ষ শ্রমিকরা তুলনামূলক বেশি আয় করেন, তবে নতুন বা অদক্ষ শ্রমিকদের অনেক সময় কম মজুরিতে কাজ করতে হয়।
সিংগাইর উপজেলার বাবুল আহমেদ জানান, তার আড়াই বিঘা জমির ধান কাটার জন্য তিনি দুজন শ্রমিক নিয়েছেন প্রতিজনকে ৭০০ টাকা মজুরি এবং তিনবেলা খাবার দেওয়ার শর্তে।
সদর উপজেলার আল মামুন দুই বিঘা জমিতে সবজি চাষ করতে চারজন শ্রমিক প্রয়োজন হলেও দুজনই নিশ্চিত করেছেন। বাকি দুজন নিশ্চিত হলে তাদের নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।
এদিকে, কাজ পেতে না পারা শ্রমিকদের জন্য পরিস্থিতি বেশ কঠিন। দিন শেষে যারা কাজ পান না, তাদের রাত কাটাতে হয় বাস টার্মিনাল, ল কলেজ বা সদর হাসপাতালের বারান্দায়।
পাবনা থেকে আসা শ্রমিক মফিজুল ইসলাম বলেন, কাজ না পেলে আমাদের দিন কেটে যায় অভুক্ত। রাতে হোটেলে থাকার মতো সামর্থ্য থাকে না, তাই আমরা বাইরে রাত কাটাই। এতে প্রায়ই চুরি-ছিনতাইয়ের শিকার হতে হয়।
শ্রমিকরা জানান, দিনমজুরদের জন্য কাজের সুযোগ থাকলেও বিশ্রাম এবং নিরাপত্তার অভাবে তাদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত কষ্টকর।
মোহাম্মদ আলী নামে এক শ্রমিক বলেন, যদি আমাদের জন্য কোনো বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে আমরা অনেক স্বস্তি পেতাম। সরকারের উচিত এই বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া।
তবে এই হাটের শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।
আইনজীবী শাকিল আহমেদ বলেন, কৃষিকাজে শ্রমিক নিতে বাধ্য হলেও তাদের বিষয়ে অনেক তথ্য অজানা থাকে। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে শ্রমিকদের পরিচিতি ও তথ্য সংরক্ষণ করা উচিত। এটি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
মানিকগঞ্জ সদর থানার ওসি আমান উল্লাহ জানান, শ্রমিকদের বিষয়ে আমরা সচেতন। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত টহল দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া প্রতিদিনই শ্রমিকদের তথ্য যাচাই করা হয়। মানিকগঞ্জের এই শ্রমিকের হাট শুধু জীবিকার উৎস নয়, এটি দরিদ্র মানুষের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। তবে তাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ এবং মৌলিক সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে শ্রমিকদের জীবনযাত্রা আরো উন্নত হবে।
|