মিয়া আবদুল হান্নান : আজ ২৭ মার্চ ২৬ রমজান বৃহস্পতিবার দিনগত রাতে লাইলাতুলকদর বা শবে কদর রাত। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও আমাদের মাঝে এসেছে মাহে রমজান এবং দেখতে দেখতে রমজান চলে এসেছে তার শেষ দশকে বা মাগফেরাতের দিন সমুহে। যারা মর্যাদার মাস রমজান পেলো অথচ নিজেদের গুনাহ মাফ করাতে পারলো না তাদের চেয়ে দুর্ভাগা আর কেউ নেই,নবী করীম (সাঃ) সেসব ব্যক্তি ও রোজাদারদের জন্য অভিশাপ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে হাদিসে বলা হয়েছে, " হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ওই ব্যক্তির নাক ধূলিমলিন হোক, যার জীবনে রামজান মাস এলো, অথচ নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারলো না"। (তিরমিজি শরীফ)। পবিত্র এই মাস ইবাদতের মাস , ক্ষমার মাস । নবী (সাঃ) বলেছেন,"তোমরা রমজানের শেষ দশকের বে-জোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর তালাশ করো" (বুখারি শরীফ)। এই মাসের শেষ দশ দিনের বিজোড় রাতে এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যদিও অনেক মনে করেন ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে শবে কদর তবে তা স্থির কোন বিষয় নয় বরং শেষ দশকের যে কোন বিজোড় রাতেই তা হতে পারে । আর তাই আমাদেরকে সবগুলি বিজোড় রাতেই ইবাদতের মাধ্যমে লাইলাতুল কদর তালাশ করতে হবে।
শবে কদর রমজানের মধ্যেই এবং শেষ দশদিনের বিজোড় রাতে এতে কোন সন্দেহ নেই। রাসুলে করিম সাল্লুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,"তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে শবে কদরকে সন্ধান করো। এ রাতগুলো হলো ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯। মনে রাখতে হবে, আরবিতে দিনের আগে রাত গণনা করা হয়। আল্লাহপাক এ রাতকে গোপন রেখেছেন আমাদের উপর রহম করে। তিনি দেখতে চান এর বরকত ও ফজিলত লাভের জন্য কে কত প্রচেষ্টা চালাতে পারে। লাইলাতুল কদরে আমাদের কর্তব্য হলো বেশি বেশি নিজের জন্য আত্মীয় স্বজনদের জন্য দোয়া করা। হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, "রাসুলুল্লাহ আকরাম সাল্লুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে কদরের রাত জেগে ইবাদত করবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে"। (বুখারি শরিফ, হাদিস নং - ৩৪) মুহাক্কিকগণ বলেন, আরবিতে "লাইলাতুল কদর" শব্দদ্বয়ে নয়টি হরফ বা আরবি বর্ণ রয়েছে। আর সুরা কদরে "লাইলাতুল কদর" শব্দদ্বয় তিনবার রয়েছে। নয়কে তিন দিয়ে গুণ করলে সাতাশ হয়, তাই তাদের মতে ২৭ (সাতাশে) রমজানের রাতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। (তাফসিরে মাযহারি)। মহান আল্লাহপাক আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতদের ইবাদতের জন্য বিশেষ কিছু সুবিধা প্রদান করেছেন। এর মধ্যে পাঁচটি রাত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । যে সব রাতের ইবাদতে অশেষ সওয়াব লাভ করা যায়। ইবাদতের এই বিশেষ পাঁচটি রাত হলো ১। জুমার রাত ২। ঈদুল ফিতরের রাত ৩। ঈদুল আযহার রাত ৪। শবে বরাত বা মুক্তির রাত তথা নিসফ শাবান বা শাবান মাসের মধ্য রাত ৫। শবে কদর বা কদরের রাত অর্থাৎ মর্যাদাপূর্ণ রজনী। শবে কদর " ফারসি শব্দ। "শব" মানে রাত বা রজনী আর "কদর" মানে সম্মান, মর্যাদা, গুণাগুণ, সম্ভাবনা, ভাগ্য ইত্যাদি। শবে কদর অর্থ হলো মর্যাদার রাত বা ভাগ্যরজনী। শবে কদরের আরবি হলো লাইলাতুল কদর তথা সম্মানিত রাত। যে রাতে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে, সে রাতই লাইলাতুল কদর। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন, "নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মর্যাদাপূর্ণ কদর রজনীতে। আপনি কি জানেন, মহিমাময় কদর রজনী কী? মহিমান্বিত কদর রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাগণ হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম সমভিব্যাহারে অবতরণ করেন। তাঁদের প্রভু মহান আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সব বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে উষা পর্যন্ত"। ( সুরা আল কদর , আয়াত - ১ - ৫)। ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দি নানা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এটি "শবে কদর" নামেই সমধিক পরিচিত। লাইলাতুল কদর উপলক্ষে আমাদের করণীয় - ১। এ রাতে ইবাদাতের পূর্বে গোসল করে নেয়া উত্তম। কদরের ফজিলত পাওয়ার উদ্দেশ্যে কিছু নফল ইবাদত করা, নফল নামাজ আদায় করা। কোরআন তেলাওয়াত করা, তাছবীহ তাহলীল পাঠ করা কর্তব্য। দুই দুই রাকআত করে নফলের নিয়ত করে যেকোনো সূরাই সূরা ফাতেহার সঙ্গে মিলিয়ে নামাজ পড়া যাবে। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। উত্তম হলো নফল নামাজ ধীরে সুস্থে লম্বা লম্বা ক্বেরাত দিয়ে পড়া এবং ধীরস্থিরে রুকু-সিজদা আদায় করা। ২। লাইলাতুল কদর হলো বছরের শ্রেষ্ঠ রাত। এ রাতের শ্রেষ্ঠ দোয়া হলো ক্ষমা চাওয়ার দোয়া। এ রাতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্ষমা চাওয়ার দোয়া শিক্ষা দিলেন যে, তুমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাও, ক্ষমা পাওয়ার জন্য দোয়া করো।হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করলেন, "হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ),আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে আমি ওই রাতে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব? রাসুলুল্লাহ করীম সাল্লুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তুমি বলবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ (ইবনে মাজাহ)। কেউ যদি জীবনে অনেক কিছু পায় কিন্তু আল্লাহর ক্ষমা না পায়, তাহলে তার জীবন ব্যর্থ। তাই এ রাতে অন্তরকে নরম করে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার পূর্বে খাঁটি দিলে তওবা ইস্তেগফার করতে হয়। খাঁটি তওবার চারটি শর্ত- ১। পূর্বের গুনাহ থেকে ফিরে আসা বা গুনাহ ছেড়ে দিতে হবে। ২। গুনাহর জন্য মনে মনে অনুতপ্ত হতে হবে যে, আমি বড়ই অন্যায় করেছি । ৩। ভবিষ্যতে ওই গুনাহ আর করবো না বলে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে । ৪। বান্দাহর কোনো হক নষ্ট করে থাকলে যথাসাধ্য সে হক আদায় করে দিতে হবে। শবে কদরের রাতের আমল - বেশি বেশি নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ, সালাতুস তাসবিহ, উমরী কাজা নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দান-সদকা, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, তওবা-ইসতেগফার, দুয়া-দুরূদসহ ইত্যাদি নফল আমলের প্রতি মনযোগী হওয়া একান্ত জরুরি। শবে কদরের নামাজ - প্রকৃত অর্থে শবে কদরের আলাদা নামাজ বলে কিছু নেই, যেহেতু এই রাতটি ইবাদত বন্দেগি করে কাটাতে হবে তাই হাদিসেই এই সমাধান দেয়া হয়েছে। আর বিশ্ব মুসলিম এই রাতে বিশেষ কিছু ইবাদত পালন করে থাকেন। শবে কদরের নফল নামাজের নিয়ম - ১। এ রাতে প্রথমেই পড়া যায় দুই রাকাত তাহিয়াতুল অযুর নামায - দুই রাকাত তাহিয়াতুল অযুর নামাজের নিয়ম - প্রতি রাকাতে আলহামদুলিল্লাহ ( সূরা ফাতিহা) পড়ার পর , ১ বার আয়াতুল কুরসী এবং তিন বার ক্বুলহু আল্লাহ শরীফ ( সূরা এখলাছ) মিলিয়ে পড়া যায়। ২। দুই রাকাত,দুই রাকাত করে নফল নামায শবে কদরের নামাজ দু‘রাকাত করে যত বেশী পড়া যায় তত বেশী ছওয়াব। নামাজের প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা পড়ার পর সূরা ইখলাছ, সূরা ক্বদর, আয়াতুল কুরছী বা সূরা তাকাছুর ইত্যাদি মিলিয়ে পড়া অধিক ছওয়াবের কাজ। এই ভাবে কমপক্ষে ১২ রাকাত নামাজ আদায় করা উত্তম। এর বেশি যত রাকাত আদায় করা যায় ততই উত্তম।প্রতি ৪ রাকাত পর পর কিছু তাসবিহ-তাহলীল আদায় করে মহান আল্লাহর নিকট দোয়া কামনা করা অতি উত্তম। এই ভাবে সারা রাত নামাজ আদায় করা যেতে পারে। এছাড়া এভাবে ও করা যায়, প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা পড়ার পর, ১ বার আয়াতুল কুরসী এবং ১৫ বার করে সূরা এখলাছ শরীফ, অতঃপর সালাম ফিরানোর পর ১২ বার দুরূদ শরীফ। ফযীলত - রুজিতে রবকত, দুঃখ-কষ্ট হতে মুক্তি লাভ করবে, গুনাহ হতে মাগফিরাতের বখশিস পাওয়া যাবে।
|