আব্দুল খালেক খোন্দকার : আজ পবিত্র রমজানের ২৮তম দিনটি অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। গতকাল রাতে আমাদের বাংলাদেশে পবিত্র লাইলাতুস ক্কদর আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপিত হয়েছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ গতকাল সারারাত জেগে এবাদত বন্দেগি করেছেন। মসজিদে মসজিদে তারাবির নামাজে ক্কোরআন খতম হয়েছে। আজ সরকারি ছুটির দিন।
দেখতেদেখতে মাসটি চলে গেল। কিন্তু প্রশ্ন এ মাসের কতটুকু ফায়দা আমরা অর্জন করতে পারলাম। ২০ রামাদানের পরবর্তী রাতগুলোতে লাইলাতু ক্কদর নিহিত আছে। আমরা লায়লাতুল ক্কদর বা মহিমান্বিত রজনিগুলিতে প্রবেশ করেছি। রামাদানের শেষ দশকের যেকোন রজনীতে লাইলাতুল ক্কদর নিহিত আছে। তাছাড়াও রোজার তৃতীয় দশকে আল্লাহ মানুষকে জহান্নামের আগুন থেকে নাজাত দেন মর্মে কিছু হাদিসে উল্লেখ আছে। ।
মহিমান্বিত রজনী বা লাইলাতুল ক্কদরের ব্যাপারে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সূরা আল ক্কদর নামে একটি সূরা নাজিল করেছেন। আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, নিশ্চয়ই আমি উহা/ ক্কোরআন মজিদকে মর্ষাদআপূর্ণ রাতে নাজিল করেছি। এই মর্যাদাপূর্ণ বা ক্কদরের রাতটি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। আল্লাহ বলেছেন এ রাতে রূহ জিবরাইল (আঃ) ফেরেশতার নেতৃত্বে আল্লাহর যাবতীয় হুকুম আহকাম নিয়ে ফেরেশতাগণ পৃথিবীতে নেমে আসেন এবং ফজর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শান্তি আর শান্তি বিরাজ করতে থাকে। অতএব এই রজনীটির ফজিলত অর্জনের জন্য আমাদের মানুষিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহন করা উচিত।
প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহর ক্ষমা ব্যতীত কেউ বেহেশত অর্জন করতে পারে না। বেহেশত হচ্ছে চিরন্তন শান্তির স্থান যেখানে ধার্মিক লোকেরা পরবর্তী জীবনে স্থায়ীভাবে থাকবে।
আল্লাহর রাসূল নবী মুহাম্মদ (তাঁর উপর শান্তি) যে কোনও পাপ থেকে মুক্ত ছিলেন। তারপরেও তিনি আল্লাহর ক্ষমা চেয়েছিলেন, এক বা দু`বার নয়, দিনে সত্তর বার। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা কতবার পাপী মানুষকে একদিন আল্লাহর ক্ষমা চাইতে পারি?
নবী বলেছেন, রমজানে এই কথাগুলি বেশি বলা উচিত আর তা হ’লঃ
‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুবুন তুহিব্বুল আফওয়া ফাফুআ’ন্নি ‘হে আল্লাহ, তুমি ক্ষমাকারি ও ক্ষমা করতে ভালোবাসে; অতএব, আমাকে ক্ষমা কর। ’
রমজান মুসলমানদের সহনশীলতা, ধৈর্য , করুণা এবং সহমর্মীতা শেখায়। রমজানের রোজা রেখে অস্থিরতা, দ্বন্দ্ব, কলহ, যুদ্ধ এবং স্বার্থপরতা পরিত্যাগ করতে হবে। নইলে এই রোজা কোন কাজে আসবে না।
এ মাসের শেষে সদকাতুল ফিতর আদায়েও যত্নবান হতে হবে। সামর্থ্যবান প্রতিটি ব্যক্তিকে রমজানুল মোবারকের সিয়াম সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে যেসব দান প্রদান করা বান্দার ওপর অপরিহার্য, সদকাতুল ফিতর তার অন্যতম। আর্থিক ইবাদত হিসেবে জাকাতের কাছাকাছি পর্যায়ে এর অবস্থান। অধিকাংশ ফিকহি গ্রন্থে জাকাত অধ্যায়েই সদকাতুল ফিতরের আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজানুল মোবারকের রোজা ফরজ করা হয়। এ বছরেরই শাবান মাসে সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য করা হয়।
রামাদান মাসে কোনো প্রকার অপচয় না করে মানুষের সেবায় দান-সদকা করলে অত্যন্ত বরকত পাওয়া যায়। এতে অভাবক্লিষ্ট মানুষের কল্যাণ হয় এবং মানবতা উপকৃত হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী! তাদের ধন-সম্পদ থেকে সদকা নিয়ে তাদেরকে পাক-পবিত্র করুন, তাদের এগিয়ে দিন এবং তাদের জন্য রহমতের দোয়া করুন। (সুরা তওবা : ১০৩)।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবকুলের মধ্যে সর্বাধিক উদার ও দানশীল ছিলেন। রমজান মাসে যখন জিবরাইল আলাইহিস সালাম নিয়মিত আসতে শুরু করতেন, তখন তার দানশীলতা বহুগুণ বেড়ে যেত। (বোখারি)। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে কাউকে অধিকতর দয়ালু দেখিনি।’ (মুসলিম)। অন্য বর্ণনায় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানের হাত এতটা প্রসারিত ছিল যে, সকালবেলা যদি ওহুদ পরিমাণ সম্পদও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে রাখা হয়, আমার মনে হয়, মাগরিব আসার আগেই তিনি সব দান করে শেষ করে ফেলবেন। (বোখারি ও মুসলিম)।
রমজানে প্রতিটি ভালো কাজের নেকি ৭০ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এ মাসে যত বেশি দান-সদকা করা যাবে, তা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রিয় উম্মতকে রমজান মাসে বেশি পরিমাণে দান করতে উৎসাহিত করতেন। রমজান মাসে একটি নফল আমল ফরজের মর্যাদায় সিক্ত। সে হিসেবে রমজান মাসে আমাদের প্রতিটি দান-সদকাই ফরজ হিসেবে আল্লাহতায়ালার কাছে গণ্য।
আল্লাহর নবী বলেন, রমজানে তোমরা এই কথাগুলি বেশি বেশি বলঃ
‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুবুন (কারীম) তুহিব্বুল আফওয়া ফাফুআ’ন্নি। হে আল্লাহ, তুমি ক্ষমাকারি ও ক্ষমা করতে ভালোবাস; অতএব, আমাকে ক্ষমা কর। ’ অতএব এই দোয়াটি আমাদের সকলের বেশি বেশি পড়া উচিত।
এছাড়াও রোজা শেষে ইফতারের ফজিলত অশেষ রয়েছে। অপরকে ইফতার করানোর সওয়াব অনেক বেশি রয়েছে বলে আল্লাহর নবী বলেন। রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে এবং রোজাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব সে লাভ করবে।
রমজানে রোজাদারকে ইফতার করানো হলো, মুমিনের বিশেষ আমল। এ বিশেষ আমলের বিনিময়ে মহান আল্লাহ বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। এ ছাড়াও রয়েছে অনেক ফজিলত। অন্য রোজাদারকে ইফতার করানো নেকি বৃদ্ধির আমল ও পাপ মোচনের আমল হিসেবে ঘোষণা করেছেন নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হাদিসে এসেছে,
হজরত যায়েদ ইবনে জুহানি রা. বর্ণনা করেছেন, রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
যে ব্যক্তি রোজাদারকে ইফতার করালো, তারও রোজাদারের ন্যায় সওয়াব হবে; তবে রোজাদারের সওয়াব বিন্দুমাত্র কমানো হবে না। (তিরমিজি ৮০৭)
আল্লাহ বলেন, তাঁর সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে, আসমায়ুল হুসনা। এসব নাম ধরে আল্লাহকে স্মরণ করা উচিত।
ভোজন ও পানীয় রমজানের রোজার সারমর্ম নয়। মুসলমানদের রমজান মাসে অতিরিক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
দুঃখের বিষয় এই যে, রমজান মাসে আমাদের মধ্যে অতি ভোজনের আকাঙ্খা বেড়ে যায়। ধনী শ্রেনীর মব্যে প্রচুর মজাদার খাবার আয়জন করা হয় এবং অনেক খাবার অপচয় করা হয়। এটা সিয়ামের ব্রত নয়। আত্ন সংযোগ করতে শেখার জন্যই এ মাসটি মু’মিন মুসলমানদের মধ্যে আসে। কাজেই আমাদের এমন কাজ করতে হবে যাতে তাক্কওয়া অর্জন হয়।
রমজান মাসে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়। তাই এ মাসে বেশি বশি ক্কোরআন তেলাওয়াতে উৎসাহিত করা হয়। আমাদের দেশে মসজিদে তারাবীর নামাজে কোরআন খতম করার প্রচলন আছে। ২০ রাকাত তারাবীর নামাজ পড়া হয়। এভাবে ২৭ রমজানের রাতে ক্কোরআন খতম করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ ২০ রাকাত তারাবী নামাজ আদায় করতে গিয়ে হাফেজগন দ্রুত কোরআন পাঠ করে থাকেন। ফলে পবিত্র ক্কোরআন পাঠে বাক্যের বিরাম চিহ্ন যেমন দাড়ি, কমা,সেমি কোলন, প্রশ্নবোধক চিহ্ন কিছুই থাকে না। ফলে এটা দূর্বোদ্ধ মন্ত্র পাঠ সাদৃশ্য হয়ে যায়।
আল্লাহর বাণী এভাবে পাঠ করা চরম গোনাহের কাজ হয় এবং ক্কোরআন মজীদের সাথে বেয়াদবি হয় বলে অনেক মুফতি, মাওলানা অভিমত দিয়েছেন। ধীরস্থির ও স্পষ্ট করে আল্লাহর কালাম পাঠ করার জন্য আল্লাহ হুকুম করেছেন (সূরা মুজ্জামিল।) তারতিলার সাথে পূর্ণ এক বা দেড় পারা ক্কোরআন পাঠ করে ২০ রাকাত তারাবী আদায় করতে দীর্ঘ সময়ের দরকার। গণ মুসল্লিদের কথা ভেবে মন্ত্র পাঠের মত করে ক্কোরআন মজিদ পাঠ করে ২৭ রমজানের মধ্যেই ক্কোরআন খতম করা হয়।
তাই বিজ্ঞ আলেমগণ বলেছেন, তারতিলার সাথে এক বা দেড় পারা ক্কোরআন পাঠ করে যদি দীর্ঘ ২০ রাকাত তারাবি নামাজ আদায় সম্ভব না হয়, তবে প্রতি তারাবীতে হুরাহুরি করে একপারা কোরআন পাঠ না করে কোরআনের আয়াত পাঠের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া উচিত। এক পারার তিন ভাগের এক দিয়ে ২০ রাকাত তারাবি আদায় করলে এত হুরাহুরি করা লাগে না। অথবা রাকাতের সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে এক পারা কোরআন পাঠ করা উচিত। অল্প রাকাতে এক পারা কোরআন তেলাওয়াত করলে তারতিলার সাথে পাঠ করা সম্ভব। যদি ২০ রাকাতের স্থলে ৮ রাকাত পড়া হয়, তবে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কোরআন তেলাওয়াত করা যায় আর অনেক সহজেই তারাবী নামাজ উত্তমভাবে আদায় হয়ে যায়। আর যদি ২০ রাকাতই আদায় করতে হয় তবে এক পারার তিন ভাগের এক ভাগ তেলাওয়াত করে তারাবি আদায় করলে আয়াতসমূহ পাঠে অতি ব্যস্ততা ও হুরাহুরি থাকে না। ফলে কোরআন পাঠে বেয়াদবি হয় না। এ মতটি আমার নিকট খুবই চমৎকার ও গ্রহণযোগ্য।
রমজান মুসলমানদের সহনশীলতা, ধৈর্য , করুণা এবং সহমর্মীতা শেখায়।
রমজানের রোজা রেখে অস্থিরতা, দ্বন্দ্ব, কলহ, যুদ্ধ এবং স্বার্থপরতা পরিত্যাগ করতে হবে। নইলে এই রোজা কোন কাজে আসবে না।
|