এমএম রহমাতুল্লাহ: ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয় ফিলিস্তিন ইস্যুর পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে বলে মন্তব্য করেন আন্তর্জাতিক আল-কুদস দিবস উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভার বক্তারা। প্রতিবছরের ন্যায় এবারো আলকুদস দিবস উপলক্ষ্যে ‘কুদস ও ফিলিস্তিনের মুক্তি: অব্যাহত প্রতিরোধের অনিবার্যতা’ শীর্ষক আলোচনার সভার আয়োজন করে আল কুদস-কমিটি, বাংলাদেশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনের মুজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকিব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত এক্সিলেন্সী মানসুর চাভোশী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান। সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ রেজা মীর মোহম্মদী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ কে এম বদরুদ্দোজা এবং বিশিষ্ট ইসলামি স্কলার ড. একেএম আনোয়ারুল কবীর। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিনিয়র সাংবাদিক ও চেঞ্জটিভির প্রতিষ্ঠাতা আমীরুল মুমিনীন মানিক।
সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশ-এর সাধারণ সম্পাদক মুস্তফা তারিকুল হাসান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ও আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশ-এর সভাপতি অধ্যাপক ড. শাহ্ কাউছার মুস্তাফা আবুল উলায়ী।
উপরোক্ত অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ফিলিস্তিন জুড়ে পবিত্র রমজানের মধ্যেই যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ করে পশুশক্তি ইসরাইল আবারও শুরু করেছে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম গণহত্যা। মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস এর পবিত্র ভূমিতে এ অন্যায় ও হত্যাযজ্ঞ চলছে। বায়তুল মুকাদ্দাস পৃথিবীর সমস্ত শৌর্য বীর্যের ইতিহাস যেখানে স্থির হয়ে আছে। বায়তুল মুকাদ্দাস ও তার আশপাশের এলাকা তথা সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ড বহু নবী-রাসূলের স্মৃতিবিজড়িত এবং কোরআন মজিদে এ পুরো ভূখণ্ডকে ‘পবিত্র ভূমি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই মসজিদুল আকসা, বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিনের প্রতি ভালোবাসা প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত। ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের ক্রুসেডার খ্রিস্টানরা সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে নেয়ার পর বায়তুল মুকাদ্দাসের বিভিন্ন ইসলামী স্থাপনায় পরিবর্তন আনে। এরপর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ুবি বায়তুল মুকাদ্দাস শহরকে আবারও মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। তবে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানকার মুসলমানদের ওপর বিপদ নামতে শুরু করে।
বিংশ শতাব্দীর ৪০ এর দশকে ইহুদিবাদী ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনের ভূমি ও পবিত্র কুদস দখলের পর একটি কঠিন সময়কাল অতিবাহিত হয়েছে এবং সেখানকার রাজনৈতিক জীবনে অনেক উত্থান পতন হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয় ফিলিস্তিন ইস্যুর পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে। ইরানের বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী দখলদার ইহুদীবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পতাকা উড্ডীন করেন এবং কুদস শরীফ ও ফিলিস্তিনের ইসলামি ও পবিত্র ভূমির মুক্তির বিস্মৃত লক্ষ্য ও আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ইমাম খোমেনীর পক্ষ থেকে রমজান মাসের শেষ দশকের শুক্রবারকে আল কুদস দিবস নামকরণ ছিলো একটি বৃহৎ বুদ্ধিবৃক্তিক ও গঠনমূলক রাজনৈতিক উদ্যোগ, যা ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের পথকে পাল্টে দেয় এবং এই পথটিকে আলোকিত ও মসৃণ করে তোলে। সেই পথ ধরে আল কুদস কমিটি বাংলাদেশও সোচ্চার হচ্ছে সম্মিলিত প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাতে।
আলোচনা সভায় বক্তারা আরও বলেন, ফিলিস্তিনের সংকট কেবল ফিলিস্তিনের জনগণের সংকট নয়, এটা গোটা ইসলামী বিশ্বের সংকট। তাই বিশ্বের সকল মুসলমানকে এই সংকট নিরসনে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বক্তারা আরো বলেন, মুজলুমের বিরুদ্ধে জালেমের অত্যচার চিরকাল থাকতে পারে না।
শত প্রতিকূলতা সত্বেও অবৈধ দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যোদ্ধারা যেভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তাতে ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি একদিন স্বাধীন হবেই।
ইমাম খোমেনির ডাকে গঠিত আল-কুদস দিবস উপলক্ষ্যে এর আগে ২০২৪ সালেও আল-কুদস কমিটি, বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে এক অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত মানসুর চাভোশি এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক নির্বাচন কমিশনার এবং বর্তমান নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান ও আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশ এর সভাপতি অধ্যাপক ড. শাহ কাওসার মুস্তাফা আবুল উলায়ীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের তৎকালীন কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ রেজা মীর মোহাম্মদী। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট একেএম বদরুদ্দোজা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ এর তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. শেখ আবদুস সালাম উল্লেখ করেন, আন্তর্জাতিক আল কুদস দিবস এমন সময় পালিত হচ্ছে, যখন ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইহুদিবাদী ইসরাইলের পাশবিক হামলা অব্যাহত রয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইহুদিবাদী ইসরাইল গাজা উপত্যকা এবং জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে মজলুম ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর নতুন করে গণহত্যা শুরু করে।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্বর ইসরাইলের হামলায় গত ১ বছরে নারী, শিশুসহ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন অগণিত বনি আদম। এছাড়া, গাজা উপত্যকায় ইহুদিবাদীদের এই বর্বর হামলায় ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফিলিস্তিনে গত অল্প কয়েকমাসের মধ্যে এতো ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রাণহানীর পরও যদি বিশ্ব বিবেক জাগ্রত না হয়, তবে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক।
ইসরাইলের বর্বর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনীরা যেভাবে প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে ফিলিস্তিনের বিজয় একদিন আসবেই, ইনশা-আল্লাহ। কিন্তু এতোগুলো শক্তিশালী মুসলিম দেশ থাকা সত্ত্বেও আজ তাদের নীরবতায় পৃথিবীর মানচিত্র থেকে গাজা ও রাফাসহ ফিলিস্তিনের নাম মুছে ফেলতে চায় ইসরাইলের হায়েনারা।
প্রতিবছর রমজান মাসের শেষ শুক্রবার পালিত হয় আন্তর্জাতিক আল-কুদস দিবস। নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ এবং ফিলিস্তিনে ইহুদীবাদীদের আগ্রাসনের নিন্দা জানাতে ও বিশ্বের মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করার উদ্দেশ্যে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনি (র.) এই দিবসটি পালনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখন থেকেই এ দিবসটি উদযাপনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিন ও গাজার নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে তাদের সংহতি ঘোষণা করছে। ফিলিস্তিনের সমস্যা সমাধানের জন্য ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে এই দিনটি বড় সুযোগ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। মুসলমানদের উচিত এই সুযোগকে সচেতনভাবে উপলব্ধি করা এবং সমস্যার সমাধানের জন্য ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। উল্লেখিত অনুষ্ঠানে ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ রেজা মীর মোহাম্মদী উল্লেখ করেন, এ বছরের আন্তর্জাতিক কুদস দিবস অন্যান্য বছরের তুলনায় একেবারেই অন্যরকম। কেননা, এ বছর ফিলিস্তিনে মানবতার যে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটেছে, ইতিহাসের ভয়াবহতম ও নৃশংসতম গণহত্যা চলছে, তা আমাদের হৃদয়কে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত করে তুলছে। নিরীহ ও নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি নারী-শিশুসহ বেসামরিক জনগনের উপর জায়নবাদী আগ্রাসী রাষ্ট্র ইসরায়েলের চলমান এই আক্রমণ ও গণহত্যা অভিযান থেকে আমরা দুটি জিনিস দেখতে পাচ্ছি- তাহলো এমন ভয়াবহতার মুখেও বিশ্বের নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলোর আশ্চর্যজনক নীরব ভূমিকা। আর এর বিপরীতে এমন নৃশংসতম জুলুমের মধ্যেও ফিলিস্তিনিদের অবিশ্বাস্য ঈমানী দৃঢ়তা এবং প্রতিরোধ।” তারা আরো বলেন, “বর্তমানে ফিলিস্তিনে যা ঘটছে, তার প্রতিবাদ প্রতিরোধ করা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ও রাষ্ট্রের মৌলিক, মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক দায়িত্ব। আর মুসলিম হিসেবে ইসলামি রাষ্ট্র ও জাতিগুলোর ওপর এই দায়িত্ব আরো বেশি।’
ইমাম খোমেনি (রহ.) এই দিনটিকে ইসলামি দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার এই ঘোষণার কারণেই আজ আল-কুদস দিবস একটি বৈশ্বিক রুপ পেয়েছে।
এদিকে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে পশ্চিমা দেশগুলোতেও ব্যপক গণজাগরণ, বিক্ষোভ ও মিছিল দেখা যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ মানবিকতকর দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছে। ইসরাইল ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোর ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা আশাবাদী এভাবেই একসময় এই নির্যাতক জুলুমকারী রাষ্ট্রের পতন ঘটবে ও ফিলিস্তিন ও আল কুদস আবার স্বাধীন হবে। আর ফিলিস্তিনের এই পথচলায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তাদের পাশে রয়েছে, আগামীতেও থাকবে।
বিগত বছরগুলোতে একমাত্র ইরানই ইসরাইলকে শিক্ষাদেয়ার জন্য বারবার হামলা করে। কিন্তু ওআইসি`র সদস্যভুক্ত অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর নীরবতায় ফিলিস্তিনের বিজয় অর্জিত হয়নি।
পবিত্র নগরী আল কুদস বা বায়তুল মুকাদ্দাস হচ্ছে পবিত্র মক্কা মু‘আযযামা ও মদিনা মুনাওয়ারার পরে ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থান; যেখানে অবস্থিত ইসলামের প্রথম কিবলা মসজিদুল আকসা। হজরত মুহাম্মদ (সা:) এ মসজিদুল আকসা থেকেই মিরাজে গমন করেছিলেন। তাই বায়তুল মুকাদ্দাস দুনিয়ার অন্য অনেক ভূখণ্ডের মতো কোনো সাধারণ ভূখণ্ড নয়। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী চক্র সাম্প্রদায়িক ইহুদি জায়নিস্টদের ইন্ধন জুগিয়ে ফিলিস্তিনের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। তারা একের পর এক গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে এবং মুসলমানদের বর্বরোচিতভাবে শহর ও গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করেছে। ফিলিস্তিন জবরদখলদার সাম্প্রদায়িক ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা সংগ্রাম ও যুদ্ধ করে চলেছে। বিশ্বের মুসলমানদের উচিত সংগ্রামী ফিলিস্তিনীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা। তাহলেই একদিন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে, শিশুদের কোলাহলে জেগে উঠবে ফিলিস্তিনের ভূমি।
|