আন্তর্জাতিক ডেস্ক : পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে বুধবার (৭ মে) ভোরে যখন বিকট শব্দে তার বাড়ি কেঁপে ওঠে তখন মোহাম্মদ ওয়াহিদ ছিলেন গভীর ঘুমে। তিনি বলেন, ‘আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরও ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করলে আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা শুরু হয়।’
বিছানা থেকে লাফিয়ে নামেন এবং পরিবারের অন্যদের নিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে বাইরের দিকে দৌড়ে যান তিনি। ওয়াহিদ বলেন, ‘বাচ্চারা কাঁদছিল, নারীরা এদিক-ওদিক দৌড়চ্ছিল। তারা নিরাপদ জায়গা খোঁজার চেষ্টা করছিল।’
ওয়াহিদ বাস করেন পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরবাদে। বুধবার (৭ মে) ভোরে এর অন্তত তিনটি জায়গায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত।
ভারতের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, ভারত শাসিত কাশ্মীরে ২৬ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যার জবাবে এই হামলা চালিয়েছে তারা।
কাশ্মীরে হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকেই দায়ী করছে ভারত এবং এতে ইসলামাবাদের কৌশলগত সমর্থন ছিল বলেও অভিযোগও করেছে দেশটি। তবে এমন অভিযোগ সবসময়ই প্রত্যাখ্যান করে আসছে পাকিস্তান।
ভারত ও পাকিস্তান শাসিত উভয় কাশ্মীরে প্রত্যক্ষদর্শীরা বিবিসির কাছে ভারতের হামলা ও পাকিস্তানের গোলাবর্ষণের পরবর্তী পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন।
পাকিস্তান বলেছে, ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তাদের ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে আরও ৪৬ জন।
ভারতীয় সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে কমপক্ষে ১৫ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৪৩ জন আহত হয়েছে।
রুবি কাউর নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে ভারতীয় পুঞ্চ জেলায় বাস করতেন এবং ভারতীয়দের মধ্যে যারা নিহত হয়েছেন তিনি তাদের একজন।
তার চাচা বুয়াভা সিং বিবিসিকে বলেছেন যে রাত পৌনে দুইটার দিকে মিস কাউরের বাসার কাছে মর্টার শেল আঘাত হানে। তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান এবং তার কন্যা আহত হয়।
বুয়াভা সিং বলেন, ‘তার স্বামীর শরীর ভালো যাচ্ছিল না। তিনি উঠেছিলেন স্বামীর জন্য চা বানাতে। ঠিক তখনই তার ঘরের একেবারে কাছেই মর্টার শেলটি আঘাত হানে।’
তার মতে বুধবার (৭ মে) ভোরে যেমন ভারী গোলাবর্ষণ হয়েছে তেমনটি তারা ‘আগে আর দেখেননি’।
ওই এলাকায় কোনো কমিউনিটি বাঙ্কার ছিল না। ফলে সেখানকার মানুষজনকে তাদের ঘরবাড়িতেই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে।
বুয়াভা সিং বলেন, ‘গোলার টুকরো তার মাথায় এসে লেগেছিল। ব্যাপক রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো তখন। দ্রুতই আমরা কাছের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।’
ওই এলাকার আরেকজন অধিবাসী জানিয়েছেন, তারা বুধবার রাতে কয়েক ঘণ্টা ধরেই বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন।
ড. জামরুদ মুঘল ফোনে বলেন, ‘শহর এবং নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছাকাছি এলাকাজুড়ে ছিল আতঙ্কময় পরিস্থিতি।’
তিনি বলেন, ‘সারা রাত মানুষ ঘুমাতে পারেনি। লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দৌড়েছে। মূল শহরে ফরেস্ট অফিসের কাছে গোলা আঘাত হেনেছে এবং তাতে সেখানকার কাছাকাছি স্থাপনার ক্ষতি হয়েছে।’
পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের মুহাম্মদ ইউনিস শাহ বর্ণনা করেছেন, কীভাবে ভারতীয়দের দিক থেকে আসা চারটি ক্ষেপণাস্ত্র নানগাল সাহাদান শহরতলী এলাকার একটি এডুকেশনাল কমপ্লেক্সে আঘাত করে। সেখানে এর জেরে একটি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সেখানে বাচ্চাদের স্কুল ও কলেজ, একটি হোস্টেল এবং একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছিল।’
উদ্ধার অভিযান চলার সময় স্থানীয়রা জানান, সহিংসতা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা এবং এরপর কী হবে তা নিয়ে তারা আতঙ্কিত।
ওয়াহিদ বলেন, ‘আমরা আতঙ্কিত। কী করতে হবে তা আমরা জানি না। লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছে এবং অনিশ্চয়তার অনুভূতি সবার মধ্যে।’
তার এলাকারই শাহনেওয়াজও একই কথা বলছিলেন। তিনি ও তার পরিবার ‘মরিয়া হয়ে নিরাপদ জায়গার খোঁজ করেছেন’ বলে জানান তিনি। শাহনেওয়াজ বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছিলাম যে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। আর এখন আমরা উত্তেজনা আরও বাড়ার আশঙ্কার মধ্যে আছি।’
দিল্লি জোর দিয়ে বলেছে, বুধবার রাতে তাদের পদক্ষেপ ছিল সুনির্দিষ্ট, পরিমিত এবং চরিত্রের দিক থেকে উত্তেজনা বাড়ানোর মতো নয়।
যদিও পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের স্থানীয়রা বলছেন, যেসব এলাকা আক্রান্ত হয়েছে, তার মধ্যে তাদের মসজিদ ও আবাসিক এলাকাও রয়েছে।
ওয়াহিদ বিবিসিকে বলেন, তাদের মসজিদে কেন হামলা হলো সেটি তিনি বুঝতেই পারছেন না। তার দাবি, সেখানে হামলায় কয়েক ডজন নারী-পুরুষ আহত হয়েছেন।
মুজাফফরবাদের এই বাসিন্দা বলেন, ‘এটা বোঝা কঠিন। এটা ছিল সাধারণ একটি মসজিদ, যেখানে আমরা দিনে পাঁচবার নামাজ পড়তাম। সেখানে সন্দেহজনক কিছু আমি কখনো দেখিনি।’
যদিও দিল্লি জোর দিয়ে বলেছে, বুধবার তাদের লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসীদের স্থাপনাগুলো এবং ‘বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্যের’ ভিত্তিতে এগুলোকে বাছাই করা হয়েছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
|