ফিরোজ মাহবুব কামাল: অস্ত্র ছাড়া যুদ্ধ হয় না। তেমনি বই ছাড়া কোন বিপ্লব হয় না। রণাঙ্গনের যুদ্ধ অস্ত্র দিয়ে হয়, আর বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধটি হয় বই দিয়ে। প্রতিটি যুদ্ধ হয় বস্তুত এ দুটি ক্ষেত্রেই। যুদ্ধের লক্ষ্য শুধু ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র পাল্টানো নয়, বরং চেতনার মানচিত্র পাল্টানোও। এজন্যই অস্ত্রের বলের সাথে চাই বুদ্ধিবৃত্তিক বল তথা বইয়ের বল। বইয়ের বল না থাকলে সে যুদ্ধে প্রকৃত বিজয় আসে না। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ও পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ জয় এসেছে নবীজী (সা:)’র নেতৃত্বে। তাতে শুধু সামরিক বিজয় আসেনি, বিজয় এসেছে বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণেও। ফলে ভূ-রাজনৈতিক ভূগোলের সাথে পাল্টে গেছে বিশাল এলাকার জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও চেতনার ভূগোল। সে বিজয় থেকে সূচনা হয় ইসলামী রাষ্ট্র বিপ্লবের এবং তাতে প্রতিষ্ঠা পায় ইসলামী রাষ্ট্র। সে ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রের উপর প্রতিষ্ঠা পায় মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। এবং সে বিপ্লবের মূলে ছিল মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব আল কুর’আন। এ পবিত্র কিতাব ছাড়া সেদিন সে বিপ্লব অসম্ভব ছিল। ইউরোপের ইতিহাস সবচেয়ে বড় বিপ্লব ছিল ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব। সে বিপ্লবের মূলেও ছিল বই। সেদিন সে বই লিখেছিলেন রুশো, ভল্টিয়ার ও অন্যান্য মনিষীগণ। রাশিয়ার বুকে কম্যুনিষ্টদের ১৯১৭ সালে সে বিশাল বিপ্লব, তার পিছনেও ছিল বই। সে বইটি ছিল কার্ল মার্কসের লেখা “দাস ক্যাপিটাল”।
তাই বিপ্লবের স্বপ্ন দেখলে বইয়ের বিকল্প নাই। বই বিপ্লবের পক্ষে বয়ান তৈরী করে -যা জনগণকে বিপ্লবের সৈনিকে পরিণত করে। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অপরিহার্য যেমন অস্ত্র, অজ্ঞতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তেমনি বই। নিরস্ত্র অবস্থায় যেমন স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও ইজ্জত বাঁচে না, অজ্ঞতায় তেমনি ঈমান বাঁচে না। কারণ ঈমানের খাদ্য হলো জ্ঞান -বিশেষ করে পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান। তাই অস্ত্রের প্রস্তুতিটি যেমন ফরজ, তেমন ফরজ হলো জ্ঞানবান হওয়াটি। মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থাকার অস্ত্রের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ এসেছে সুরা আনফালের ৬০ নম্বর আয়াতে। তাই নিরস্ত্র থাকাটি বেঈমানী। তেমনি কুর’আনী জ্ঞানের অস্ত্রে নিরস্ত্র থাকাটিও বেঈমানী। অজ্ঞতা জাহান্নামে নেয়। অজ্ঞতার ভয়াবহ নাশকতা থেকে বাঁচানোর জন্যই জ্ঞানার্জনকে নামাজ-রোজা ফরজ করার আগে ফরজ করা হয়েছে। মুসলিমদের পরাজয় ও পরাধীনতার শুরু তখন থেকেই যখন তারা সামরিক অস্ত্রের সাথে জ্ঞানের অস্ত্রেও দুর্বল হতে শুরু করেছে।
জ্ঞানের অস্ত্রে মুসলিমদের দুর্বলতার প্রমাণ, সাড়ে ৬ কোটি ব্রিটিশ প্রতি বছর যে পরিমান বই প্রকাশ করে তা বিশ্বের ১৫০ কোটির বেশী মুসলিম তা প্রকাশ করেনা। অতি পরিতাপের বিষয় হলো, পবিত্র কুর’আনের ন্যায় জ্ঞানের যে সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাবটি মুসলিমদের হাতে রয়েছে -সে কিতাবও মুসলিমগণ বুঝে পড়ার প্রয়োজন বোধ করে না; সে কিতাব তারা না বুঝে তেলাওয়াত করে দায়িত্ব সারে। তারা কুর’আন পড়ে সওয়াবের আশায়, হিদায়েত নেয়ার জন্য নয়। মহান তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ এই দানটির সাথে এরচেয়ে বড় ধৃষ্টতা আর কি হতে পারে? অথচ কুর’আনের সাথে সে ধৃষ্টতা বাড়ানো হচ্ছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার ন্যায় অনারব মুসলিম দেশগুলির মাদ্রাসাগুলিতে। পবিত্র কুর’আনের সাথে সম্পৃক্ত সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে না এমন কি আরব দেশগুলিতেও। অথচ মুসলিমদের বিজয় একমাত্র তখনই এসেছিল যখন তারা এই পবিত্র কুর’আন বুঝার স্বার্থে নিজেদের মাতৃভাষাকে বর্জন করে আরবী ভাষাকে গ্রহণ করেছিল। অথচ কুর’আন হলো আল্লাহ তায়ালার রশি। পবিত্র কুর’আন দিয়েছিল তাদের আত্মার পরিশুদ্ধি এবং সংযোগ বাড়িয়েছিল তাদের রব’য়ের সাথে। তাতে তারা পরিণত হয়েছিল সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তায়ালার বাহিনীতে। আর যারা পরিণত হয় আল্লাহর বাহিনীতে তাদের কি কেই পরাজিত করতে পারে?
বই নীরবে কাজ করে এবং পরিবর্তন আনে জনগণের চেতনার মডেলে। সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় সে চিন্তার পরিবর্তনকে বলা হয় প্যারাডাইম শিফ্ট -যা বিপ্লব আনে শিক্ষা, সংস্কৃতি, কর্ম, আচরণ, সমর নীতি ও রাজনীতির অঙ্গণে। তাই বাংলাদেশীদের রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, প্রশাসন, মিশন-ভিশনে বিপ্লব আনতে হলে চাই বই। ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়া যায় না, তেমনি জ্ঞানের রাজ্যে বিপ্লব ছাড়া রাজনৈতিক ও সমাজ বিপ্লব আনা যায় না। তাই অপরিহার্য হলো, চিন্তার মডেলে তথা জ্ঞানের ভূবনে বিপ্লব। এবং সে কাজে পবিত্র কুর’আনের চেয়ে শ্রষ্ঠ গ্রন্থ আর কি হতে পারে? নবীজী (সা:) তো এই কুর’আন দিয়েই মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ও সভ্যতা নির্মাণের কাজ শুরু করেছিল। আজও কি তার বিকল্প আছে?
|