বাংলার জন্য ক্লিক করুন
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
শিরোনাম : * ইসরায়েলি হামলায় সিরিয়া-লেবানন সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন   * ওবায়দুল কাদেরের ভগ্নিপতিকে কুপিয়ে জখম   * তেলের দাম এক সপ্তাহে বেড়েছে ৯ শতাংশ   * ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে শেরপুর-ময়মনসিংহে তলিয়ে গেছে ১৬৩ গ্রাম   * দুর্গাপূজার ছুটিতে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ৭ বিশেষ ট্রেন   * দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড চাঁদপুরে, জেলাজুড়ে জলাবদ্ধতা   * ৫ বিভাগে অতিভারী বৃষ্টির আভাস, চট্টগ্রামে ভূমিধসের শঙ্কা   * শেখ হাসিনার পতনের দুই মাস আজ   * শেরপুরের ৩ উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত, তিনজনের মৃত্যু   * চট্টগ্রাম বন্দরে ফের তেলবাহী জাহাজে আগুন, নিহত ১  

   মতামত -
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                 
কলকাতা প্রেসক্লাবের নিবন্ধন ৬৮ বছর পেরিয়ে- ২

প্রথমেই গ্রন্থটিতে ভারতীয় ওই দুই নির্ভীক শহীদ সাংবাদিককে উৎসর্গ করে তাঁদের অবদানের স্বীকারোক্তির চিহ্ন এঁকেছেন গ্রন্থসত্ত্বাধিকারি। গ্রন্থের প্রায় অর্ধশত পৃষ্ঠায় ওই সময়ে কলকাতার গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিকদের বাংলাদেশের চলমান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কলাম/মতামত স্থান পেয়েছে। সেসব তথ্যবহুল লেখা পত্রিকার পাতা থেকে তুলে আনা হয়েছে এই গ্রন্থে। এসব লেখা কলকাতার সংবাদমাধ্যম কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের মর্মস্পর্শী ভূমিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল বসুর মতো প্রথিতযশা লেখক-সাংবাদিকগণ মুক্তিকামী জনগণের সঙ্গে লেখনির মাধ্যমে সংহতি জানিয়েছিলেন। এছাড়া ৪৭ জন প্রথিতযশা সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে খবর সংগ্রহ করেছেন, খবর ব্যবস্থাপনা করেছেন, কীভাবে দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি অভিজ্ঞতা-সাক্ষ্য বর্ণনাসহ তাদের প্রবন্ধে অজানা আরেক ইতিহাস রচিত হয়েছে। ৩৬৮ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি একটি প্রবন্ধ শুধু ইংরেজিতে লেখা। বাকি সবই সাবলীল বাংলায় পশ্চিম বাংলার ভাষারীতিতে রচিত। ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : কলকাতার সাংবাদিক ও কলকাতা প্রেসক্লাব’ গ্রন্থটি সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন কলকাতা প্রেসক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস সুর। ২০১৯ সালে কলকাতা প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বর্ষ উপলক্ষে গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশ করে কলকাতা প্রেসক্লাব। ২০২০ সালে গ্রন্থটি ঢাকা থেকে প্রকাশ করেন বাংলাদেশ জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান সাবেক এমপি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এবছর গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা হয়েছে। নিপুণভাবে শব্দসজ্জা-পৃষ্ঠাসজ্জাসহ পুনর্মুদ্রণে গ্রন্থের অবয়বে মুকুট পরিয়েছে ঢাকার ফ্রেন্ডশিপ প্রিন্টার্স। ঢাকা প্রকাশনার দ্বিতীয় সংস্করণ করা হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ছিল বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য নিষিদ্ধ অঞ্চল। আর কলকাতা মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী দপ্তর ও লাখ লাখ বাংলাদেশের শরণার্থীর আশ্রয়স্থল। এসব কারণেই ১৯৭১ সালের মার্চ থেকেই কলকাতা আন্তর্জাতিক সংবাদ সংগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিশ্বের প্রথম শ্রেণির নিউজ এজেন্সি থেকে শুরু করে ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা প্রায়ই কলকাতায় যেতেন বাংলাদেশের খবর সংগ্রহের জন্য। ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ, টাইমস, গার্ডিয়ানও বাদ যায়নি। সংবাদমাধ্যম, শরণার্থী, ত্রাণপ্রতিষ্ঠান, কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, আমলা-মন্ত্রী গোয়েন্দাসহ সবাই কলকাতায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী, আমেরিকান সিনেটর, জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে আগা খান পর্যন্ত যুদ্ধের অবস্থা জানতে কলকাতায় এসেছেন। বাংলাদেশের যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা প্রেসক্লাবে কমপক্ষে চারবার এসেছেন এবং দু’বার সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ কভার করার জন্য কলকাতার গ্রান্ড হোটেল হয়ে ওঠে বিদেশি সাংবাদিকদের আস্তানা। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ কলকাতা প্রেসক্লাবকে সুধারসে ভরিয়ে তোলে। কেউ আসে খবর সংগ্রহ করতে, কেউ খবর হতে। কলকাতার সংবাদমাধ্যমের সংবাদ ও ছবি বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। বিশ্ববাসী জানতে পারে মুক্তিকামী জনগণের ওপর পাকিস্তানি আর্মির পৈশাচিক বর্বরতা। এভাবেই বিভিন্ন তীর্যক লেখার মাধ্যমে তৎকালীন কলকাতার সাংবাদিকরা অভিজ্ঞতার বয়ান করেছেন এই গ্রন্থে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই আমেরিকা ও পাকিস্তান সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। মুজিবনগর সরকারের পরাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ, তাঁর সচিব মহাবুবুল আলম চাষী, সাংবাদিক তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও চার-পাঁচজন মিলে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়ে তাঁরা ভাষণ দেবেন এই বলে যে তারা স্বাধীনতা চান না, পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চান। রাওয়ালপিন্ডিতে প্রস্তুতকৃত ভাষণের ওই খসড়াটি ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে আসে। নিউইয়র্কের যাত্রার জন্য বিমানে ওঠার আগেই ভারতীয় গোয়েন্দারা ধরে ফেলেন তাদের। গোয়েন্দাদের ইঙ্গিতে সাংবাদিকরা বিমানবন্দরে যান। দেখেন কীভাবে ওই ষড়যন্ত্রের যাত্রা ভণ্ডুল করে দিলো ভারতীয় গোয়েন্দারা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে বর্তমান চুয়াডাঙ্গায় ভারতীয় সাংবাদিকদের সাথে আমেরিকান সাংবাদিকের এক বাকযুদ্ধ হয়। কারণ ওই আমেরিকান সাংবাদিক ভারতীয় সাংবাদিকের কাছে জানতে চান, ‘ইজ ইট ইস্ট পকিস্তান?’ ভারতের পিটিআইয়ের রিপোর্টাররা উত্তরে বলেছিলেন, ‘নো, দিস ইজ বাংলাদেশ।’ ইতিহাসের এমন চরম সত্য ঘটনা সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের লেখনিতে উঠে এসেছে, স্থান পেয়েছে এ গ্রন্থে। তাই গ্রন্থখানি ইতিহাসের আরেকটি আকর গ্রন্থ বলা যায় নির্দ্বিধায়। গ্রন্থের বাংলাদেশ সংস্করণের প্রকাশক জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান এমপি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কত বড়, কত বিস্তৃত ছিল তার আরেকটি উদাহারণ মিলে এ গ্রন্থে; যেখানে ভারতের সব বিখ্যাত সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার বয়ান করেছেন। ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করেছে। কারণ ভিন্ন দেশের সংবাদিকদের ভাষ্য বিশ্ববাসীর কাছে আরো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে বর্তমান প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, সিক্রেটস ডকুমেন্টসের মতো আকর গ্রন্থগুলো অবশ্যই পড়তে হবে। এছাড়া সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতায় মুক্তিযুদ্ধকে জানার জন্য আবশ্যকীয় পাঠ্য এ গ্রন্থও।’ মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ভারতের দুই তরুণ শহীদ সাংবাদিককে স্মরণ করে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ইন্দিরা গান্ধীসহ ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও কলমযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। কলকাতা প্রেসক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস সুর তাঁর গ্রন্থাভাষে বলেছেন, ‘একটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রতিবেশী দেশের সহায়তা এবং ফলশ্রুতিতে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম, এই বিশাল কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের অভিজ্ঞতায় ভরা সংকলন গ্রন্থটি এক ঐতিহাসিক দলিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্ধশত বর্ষের প্রাক্কালে গ্রন্থটি ইতিহাসের নতুন দলিল হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা ইতিহাস জানার খোরাক জোগাবে। সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, গবেষকসহ ইতিহাস পিপাসুদের গ্রন্থখানি জ্ঞানপিপাসা মেটাবে বলেই আমার বিশ্বাস। সাংবাদিকরা ইতিহাসের স্রষ্টা নন, ইতিহাসের দ্রষ্টা। ইতিহাসের নির্মম সত্য উৎঘাটিত হয় সাংবাদিকদের লেখনিতে। গ্রন্থখানি সাংবাদিক তথা কলমযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা-সমৃদ্ধ লেখনিতে ভরপুর বাংলাদেশের ঐতিহাসিক তথ্যের নিরেট দলিল। অসিযুদ্ধ, মসিযুদ্ধ ও বাকযুদ্ধের ফলশ্রতিতেই এই স্বাধীন সোনার বাংলাদেশ। এসবের বয়ান-বিবরণ উঠে এসেছে কলমযোদ্ধাদের লেখনিতে। তাই গ্রন্থখানি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।

কলকাতা প্রেসক্লাবের নিবন্ধন ৬৮ বছর পেরিয়ে- ২
                                  

প্রথমেই গ্রন্থটিতে ভারতীয় ওই দুই নির্ভীক শহীদ সাংবাদিককে উৎসর্গ করে তাঁদের অবদানের স্বীকারোক্তির চিহ্ন এঁকেছেন গ্রন্থসত্ত্বাধিকারি। গ্রন্থের প্রায় অর্ধশত পৃষ্ঠায় ওই সময়ে কলকাতার গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিকদের বাংলাদেশের চলমান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কলাম/মতামত স্থান পেয়েছে। সেসব তথ্যবহুল লেখা পত্রিকার পাতা থেকে তুলে আনা হয়েছে এই গ্রন্থে। এসব লেখা কলকাতার সংবাদমাধ্যম কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের মর্মস্পর্শী ভূমিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল বসুর মতো প্রথিতযশা লেখক-সাংবাদিকগণ মুক্তিকামী জনগণের সঙ্গে লেখনির মাধ্যমে সংহতি জানিয়েছিলেন। এছাড়া ৪৭ জন প্রথিতযশা সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে খবর সংগ্রহ করেছেন, খবর ব্যবস্থাপনা করেছেন, কীভাবে দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি অভিজ্ঞতা-সাক্ষ্য বর্ণনাসহ তাদের প্রবন্ধে অজানা আরেক ইতিহাস রচিত হয়েছে। ৩৬৮ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি একটি প্রবন্ধ শুধু ইংরেজিতে লেখা। বাকি সবই সাবলীল বাংলায় পশ্চিম বাংলার ভাষারীতিতে রচিত। ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : কলকাতার সাংবাদিক ও কলকাতা প্রেসক্লাব’ গ্রন্থটি সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন কলকাতা প্রেসক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস সুর। ২০১৯ সালে কলকাতা প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বর্ষ উপলক্ষে গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশ করে কলকাতা প্রেসক্লাব। ২০২০ সালে গ্রন্থটি ঢাকা থেকে প্রকাশ করেন বাংলাদেশ জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান সাবেক এমপি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এবছর গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা হয়েছে। নিপুণভাবে শব্দসজ্জা-পৃষ্ঠাসজ্জাসহ পুনর্মুদ্রণে গ্রন্থের অবয়বে মুকুট পরিয়েছে ঢাকার ফ্রেন্ডশিপ প্রিন্টার্স। ঢাকা প্রকাশনার দ্বিতীয় সংস্করণ করা হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ছিল বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য নিষিদ্ধ অঞ্চল। আর কলকাতা মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী দপ্তর ও লাখ লাখ বাংলাদেশের শরণার্থীর আশ্রয়স্থল। এসব কারণেই ১৯৭১ সালের মার্চ থেকেই কলকাতা আন্তর্জাতিক সংবাদ সংগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিশ্বের প্রথম শ্রেণির নিউজ এজেন্সি থেকে শুরু করে ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা প্রায়ই কলকাতায় যেতেন বাংলাদেশের খবর সংগ্রহের জন্য। ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ, টাইমস, গার্ডিয়ানও বাদ যায়নি। সংবাদমাধ্যম, শরণার্থী, ত্রাণপ্রতিষ্ঠান, কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, আমলা-মন্ত্রী গোয়েন্দাসহ সবাই কলকাতায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী, আমেরিকান সিনেটর, জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে আগা খান পর্যন্ত যুদ্ধের অবস্থা জানতে কলকাতায় এসেছেন। বাংলাদেশের যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা প্রেসক্লাবে কমপক্ষে চারবার এসেছেন এবং দু’বার সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ কভার করার জন্য কলকাতার গ্রান্ড হোটেল হয়ে ওঠে বিদেশি সাংবাদিকদের আস্তানা। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ কলকাতা প্রেসক্লাবকে সুধারসে ভরিয়ে তোলে। কেউ আসে খবর সংগ্রহ করতে, কেউ খবর হতে। কলকাতার সংবাদমাধ্যমের সংবাদ ও ছবি বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। বিশ্ববাসী জানতে পারে মুক্তিকামী জনগণের ওপর পাকিস্তানি আর্মির পৈশাচিক বর্বরতা। এভাবেই বিভিন্ন তীর্যক লেখার মাধ্যমে তৎকালীন কলকাতার সাংবাদিকরা অভিজ্ঞতার বয়ান করেছেন এই গ্রন্থে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই আমেরিকা ও পাকিস্তান সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। মুজিবনগর সরকারের পরাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ, তাঁর সচিব মহাবুবুল আলম চাষী, সাংবাদিক তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও চার-পাঁচজন মিলে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়ে তাঁরা ভাষণ দেবেন এই বলে যে তারা স্বাধীনতা চান না, পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চান। রাওয়ালপিন্ডিতে প্রস্তুতকৃত ভাষণের ওই খসড়াটি ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে আসে। নিউইয়র্কের যাত্রার জন্য বিমানে ওঠার আগেই ভারতীয় গোয়েন্দারা ধরে ফেলেন তাদের। গোয়েন্দাদের ইঙ্গিতে সাংবাদিকরা বিমানবন্দরে যান। দেখেন কীভাবে ওই ষড়যন্ত্রের যাত্রা ভণ্ডুল করে দিলো ভারতীয় গোয়েন্দারা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে বর্তমান চুয়াডাঙ্গায় ভারতীয় সাংবাদিকদের সাথে আমেরিকান সাংবাদিকের এক বাকযুদ্ধ হয়। কারণ ওই আমেরিকান সাংবাদিক ভারতীয় সাংবাদিকের কাছে জানতে চান, ‘ইজ ইট ইস্ট পকিস্তান?’ ভারতের পিটিআইয়ের রিপোর্টাররা উত্তরে বলেছিলেন, ‘নো, দিস ইজ বাংলাদেশ।’ ইতিহাসের এমন চরম সত্য ঘটনা সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের লেখনিতে উঠে এসেছে, স্থান পেয়েছে এ গ্রন্থে। তাই গ্রন্থখানি ইতিহাসের আরেকটি আকর গ্রন্থ বলা যায় নির্দ্বিধায়। গ্রন্থের বাংলাদেশ সংস্করণের প্রকাশক জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান এমপি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কত বড়, কত বিস্তৃত ছিল তার আরেকটি উদাহারণ মিলে এ গ্রন্থে; যেখানে ভারতের সব বিখ্যাত সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার বয়ান করেছেন। ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করেছে। কারণ ভিন্ন দেশের সংবাদিকদের ভাষ্য বিশ্ববাসীর কাছে আরো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে বর্তমান প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, সিক্রেটস ডকুমেন্টসের মতো আকর গ্রন্থগুলো অবশ্যই পড়তে হবে। এছাড়া সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতায় মুক্তিযুদ্ধকে জানার জন্য আবশ্যকীয় পাঠ্য এ গ্রন্থও।’ মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ভারতের দুই তরুণ শহীদ সাংবাদিককে স্মরণ করে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ইন্দিরা গান্ধীসহ ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও কলমযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। কলকাতা প্রেসক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস সুর তাঁর গ্রন্থাভাষে বলেছেন, ‘একটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রতিবেশী দেশের সহায়তা এবং ফলশ্রুতিতে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম, এই বিশাল কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের অভিজ্ঞতায় ভরা সংকলন গ্রন্থটি এক ঐতিহাসিক দলিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্ধশত বর্ষের প্রাক্কালে গ্রন্থটি ইতিহাসের নতুন দলিল হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা ইতিহাস জানার খোরাক জোগাবে। সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, গবেষকসহ ইতিহাস পিপাসুদের গ্রন্থখানি জ্ঞানপিপাসা মেটাবে বলেই আমার বিশ্বাস। সাংবাদিকরা ইতিহাসের স্রষ্টা নন, ইতিহাসের দ্রষ্টা। ইতিহাসের নির্মম সত্য উৎঘাটিত হয় সাংবাদিকদের লেখনিতে। গ্রন্থখানি সাংবাদিক তথা কলমযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা-সমৃদ্ধ লেখনিতে ভরপুর বাংলাদেশের ঐতিহাসিক তথ্যের নিরেট দলিল। অসিযুদ্ধ, মসিযুদ্ধ ও বাকযুদ্ধের ফলশ্রতিতেই এই স্বাধীন সোনার বাংলাদেশ। এসবের বয়ান-বিবরণ উঠে এসেছে কলমযোদ্ধাদের লেখনিতে। তাই গ্রন্থখানি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।

কলকাতা প্রেসক্লাবের ৬৮ বছর পেরিয়ে - ১
                                  

ভারতের কলকাতা থেকে মিয়া আবদুল হান্নান : কলকাতা প্রেসক্লাবের আজ খুব কমই কোনো পরিচয়ের প্রয়োজন আছে ৷ ক্লাবটি এই উপমহাদেশে কর্মরত সংবাদকর্মী সাংবাদিক রিপোর্টারদের সবচেয়ে পুরানো প্রেসক্লাব এবং এটি তার দরকারী অস্তিত্বের ৬৮ বছর পূর্ণ করেছে৷ ক্লাবটি পশ্চিমবঙ্গ সমিতি আইন, ১৯৬২এর অধীনে নিবন্ধিত করা। কলকাতা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সম্পাদক মহাদয়ের সৌজন্য সাক্ষাৎ পাওয়ার উদ্দেশ্য গত ২৯ এপ্রিল ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ মডেল থানাধীন রুহিতপুর ইউনিয়ন থেকে বাই রোডে বাসে করে রওনা করি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : ইতিহাস ও ঐতিহ্য কলকাতার সাংবাদিক কলকাতা প্রেসক্লাব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৯৬৭-৬৯) সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সদ্য-উত্তীর্ণ, কৃতি, সাহসী, উদ্যমী তরুণ দুই ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুরজিৎ ঘোষাল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে সরাসরি খবর সংগ্রহের তাগিদে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধরত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢোকেন। এরপর তাঁদের আর খোঁজ মেলেনি। ধারণা করা হয়, তাঁরাও শহীদ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। শুধু এই দু’জন নয়, মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কলকাতার অনেক সাংবাদিক। কলকাতার লেখক-সাংবাদিক তথা সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছে।

কলকাতা প্রেসক্লাবও বাদ যায়নি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায়। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার নিরব সাক্ষী কলকাতা প্রেসক্লাব। এর মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম অন্যতম। অসিযুদ্ধের সাথে মসিযুদ্ধও চলতো সমানতালে, কলকাতা প্রেসক্লাবে ও কলকাতার গণমাধ্যমে। তবে বেশিরভাগ কলমযুদ্ধা কলকাতা থেকেই হতো। কারণ যুদ্ধরত বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের কালি-কলম নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে কলকাতার সাংবাদিকরা খবর সংগ্রহ করেছেন রণাঙ্গন থেকে, কলকাতা প্রেসক্লাবে বসে মুক্তিযুদ্ধের খবর লিখেছেন, বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। প্রকৃত কলমযুদ্ধা হয়েছে কলকাতা থেকে। প্রতিবেশী আলাদা একটি দেশ ভারতে যেভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কলমযুদ্ধ চলেছে, তা বিশ্বের অন্য কোন যুদ্ধের ইতিহাসে দেখা যায়নি। বিবিসি, আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর আর ভারতের ছোট-বড়- মাজারী- ছোট সব সংবাদপত্র যুদ্ধের খবর প্রচারে ব্যতিব্যস্ত থেকেছে।
সেসময় বাংলাদেশের খবরই প্রধান খবর ভারতে। কলকাতার সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলা ও হত্যাকাণ্ডের সব খবর সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। রণাঙ্গনের ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে সবকিছুর দ্রষ্টা হয়ে রিপোর্টাররা লিখেছেন। কলকাতার রিপোর্টাররা সে সময় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের কলম সৈনিকেরা যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন। বাংলাদেশ সরকার ভোলেনি ওইসব কলম সৈনিক যোদ্ধাদের, মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হিসেবে সম্মাননা দিয়েছে। কলকাতার সাংবাদিকদের মুক্তিযুদ্ধের ওইসব ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এবং যুদ্ধের নির্মমতা ও হত্যাজ্ঞের অজানা সব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : কলকাতার সাংবাদিক কলকাতা প্রেসক্লাব’ শীর্ষক গ্রন্থ সংকলন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। চলবে...

অল্টারনেটিভ (বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা)
                                  

ডা. নার্গিস মার্জান এমবিবিএস

পরিচালক, হামদর্দ ল্যাবরেটরীজ (ওয়াকফ) বাংলাদেশ এবং সহযোগী অধ্যাপক, হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।
আধুনিক চিকিৎসায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পরও অল্টারনেটিভ চিকিৎসায় যুক্ত থেকে এর আধুনিকায়ন ও উৎকর্ষতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।

প্রশ্নঃ মানুষ এক সময় তারে রোগ নিরাময়ের জন্য প্রকৃতির উপরই নির্ভর করত। কিন্তু পরবর্তীতে তারা ক্রমান্বয়ে সিন্থেটিক ওষুধ ব্যবহার শুরু করে। বর্তমানে তারা কেন আবার প্রাকৃতিক ওষুধের দিকে ঝুঁকে পড়ছে?

উত্তরঃ দেখুন একটি সময় ছিল যখন গাছ-পালা, শিকর-বাকর দিয়ে প্রদত্ত চিকিৎসাই ছিল একমাত্র চিকিৎসা ব্যবস্থা। মানব জাতির আবির্ভাবের পূর্ব হতেই রোগ নিরাময়ে এসকল প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এসময় প্রকৃতিতে বিচরণকারী কোন কোন প্রাণী কোন কারণে অস্বস্থি বোধ করলে কিংবা অসুস্থ হয়ে পড়লে তারা তাদের আশে-পাশে বিদ্যমান লতা-গুল্ম, পাতা, ফুল, ফল, ছাল-বাকল, গাছ-পালা সেবন করত। কখনো কখনো তারা সুফল পেত আবার কখনো কখনো তারা সুফল পেত না। সুফল পেলে ঐসকল প্রাণী মনে রাখতো তারা কোন গাছ সেবন করে সুফল পেয়েছে। পরবর্তীতে তারা অসুস্থ হয়ে পড়লে ঐ গাছের শরণাপন্ন হতো। পৃথিবীতে মানব জাতির আবির্ভাবের পরে ঠিক এভাবেই মানুষ রোগ মুক্তির জন্য গাছ-পালা নির্বাচন করেছে। আপনি নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন, জঙ্গলে সাপ ও বেজির লড়াইয়ে সাপ বেজিকে দংশন করলে বেজি অতি দ্রুত জঙ্গলের গভীরে চলে যায় এবং নির্দিষ্ট গাছের পাতা সেবন করে, যারফলে বেজির শরীরে সাপের বিষের কোন প্রভাব পড়ে না। এছাড়াও মাঝে মাঝে বিড়াল ঘাস খায়। ঘাস বিড়ালের দৃষ্টিশক্তি অক্ষুন্ন রাখে বলেই বিড়াল ঘাস খায়। ইতিহাস থেকে জানা যায় প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে এই উপ-মহাদেশে প্রাকৃতিক চিকিৎসার চর্চা শুরু হয়ে ব্যাপক সমৃদ্ধশালী হয়। এসময় হামান-দিস্তাই ছিল এসকল ওষুধ তৈরীর একমাত্র উপায়। আধুনিক ওষুধের মত সিরাপ, অয়েন্টমেন্ট, ট্যাবলেট কিংবা ক্যাপসুল এর মত কোন ডোসেজ ফর্মে এই ওষুধ তৈরী হত না। প্রাকৃতিক এই ওষুধের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো এর কোন ধরনের পাশর্^-প্রতিক্রিয়া নেই। তাই বছরের পর বছর পরম নির্ভরতায় শতভাগ আস্থার সহিত মানুষ এওষুধ সেবন করে আসছে।

প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়। জেমস ওয়াটের আবিষ্কৃত বাষ্প চালিত যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে বড় বড় ফ্যাক্টরি গড়ে উঠে এবং শিল্পোৎপাদনের হার বৃদ্ধি পায়। এসময় শিল্প কারখানায় সিন্থেটিক বিভিন্ন আকর্ষণীয় পণ্য উৎপাদিত হতে থাকে। নতুনত্বের প্রতি মানুষের প্রবল আগ্রহের ফলে মানুষ এসকল সিন্থেটিক পণ্য ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠে। বাণিজ্যিক প্রচারণা ও ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত এই চিকিৎসা পদ্ধতি, তদস্থলে প্রতিষ্ঠিত হয় সিন্থেটিক মেডিসিনের প্রভাব। থমকে দাঁড়ায় আমাদের দেশীয় চিকিৎসার ধারা।

সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন প্রতিকূলতা পেরিয়ে ন্যাচারাল মেডিসিন আজ উচ্চমাত্রায় অবস্থান করছে। গত কয়েক দশকে এর উন্নতিতে বিশ^ব্যাপী এক বিস্ময়কর আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাপী মানুষ পুনরায় ন্যাচারাল মেডিসিনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। এর কারণ হলো-
মানুষ এখন অনেক অনেক বেশি স্বাস্থ্য সচেতন। তারা এমন একটি স্বাস্থ্য সেবা চায় যেখানে সফল রোগ নিরাময়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও প্রাধান্য পাবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ এবং অবাদ তথ্যের এই যুগে মানুষ সিন্থেটিক ওষুধের ক্ষতিকর মারাত্মক পাশর্^-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পেরেছে, জানতে পেরেছে প্রাকৃতিক ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। থাকলেও তা তুলনামূলকভাবে কম এবং প্রাকৃতিক ওষুধ দীর্ঘমেয়াদী ও অত্যন্ত কার্যকরী। একারণেই মানুষ পুনরায় প্রাকৃতিক ওষুধের প্রতি আস্থাশীল হয়ে পড়ছে।

তাছাড়াও প্রাকৃতিক চিকিৎসায় রোগ নিরাময়ে শুধুমাত্র রোগীর লক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ না করে রোগীর দেহ, মন, আত্মার, সামাজিক, পারিপার্শ্বিক এবং পরিবেশগত বিভিন্ন দিক বিচার-বিশ্লেষণ করে রোগের মূল কারণ খুজে বের করে রোগটি সমূলে উপশমের জন্য চিকিৎসা প্রদান করা হয়। এতে রোগী দীর্ঘমেয়াদী উপকার লাভ করে। ফলে রোগী সাধারণ ক্রমান্বয়ে প্রাকৃতিক চিকিৎসার দিকে ঝুকে পড়ছে।

এছাড়াও প্রাকৃতিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় মানুষের রোগের চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধের উপর অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়। এতে মানুষের খাদ্য, পথ্য, পুষ্টি, ব্যায়াম এবং লাইফস্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে সুস্থতার উপর জোড় দেওয়া হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী বর্তমান জেনারেশনের নিকট এই চিকিৎসা পদ্ধতি অধিক গ্রহণযোগ্য ও ফলপ্রসূ বিবেচিত হওয়ায় তারা অধিকহারে প্রাকৃতিক চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এছাড়াও অ্যান্টিবায়োটিকস বিভিন্ন সিন্থেটিক ওষুধ রেজিস্ট্যান্ট হওয়ায়, সিন্থেটিক ওষুধের প্রতি রোগীর নির্ভরতা (আসক্তি সৃষ্টি) সৃষ্টি হওয়া, ওষুধের দুষ্প্রাপ্যতা এবং চিকিৎসার ব্যয়বহুলতার জন্যও মানুষ ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক ওষুধের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।

প্রশ্নঃ আপনিতো অল্টারনেটিভ মেডিসিনের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। আপনার এই কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ কোনো সম্মাননা বা পদক পেয়েছেন কী?

উত্তরঃ ধন্যবাদ আপনাকে। খেুন আমি এই চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর যাই করছি, তা সম্পর্ণ প্রাকৃতিক ওষুধের প্রতি ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণেই করছি। কারণ আমি পারিবারিকভাবেই খুব ছোট বয়স থেকেই এই চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর জ্ঞান লাভ করি। এরপর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় শেষে কিন্তু আমি প্রথমেই অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থার ডিইউএমএস কোর্সে ভর্তি হই। যদিও পরবর্তীতে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করি। এর মধ্যে আমি ডিইউএমএস কোর্সে এত বেশি ইন্টারেস্ট পাই যে রেকর্ড পরিমাণ নম্বর পেয়ে আমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। এতে আমাকে গোল্ড মেডেল প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে আমি অল্টারনেটিভ মেডিসিনের বিভিন্ন গ্রন্থ রচনার জন্য ‘বাংলাদেশ দেশীয় চিকিৎসক সমিতি’ কর্তৃক প্রদত্ত ‘বেস্ট রাইটার অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করি। এছাড়াও ইউনানী এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে অসামান্য অবদানের জন্য হামর্দ ল্যাবরেটরীজ ওয়াক্ফ বাংলাদেশ আমাকে ইউনানী এন্ড আয়ুর্বেদিক মেডিসিনাল অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন।

প্রশ্নঃ অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থা কী? বাংলাদেশে কী কী অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে?
কোনো একটি দেশে সমসাময়িককালীন বহুল প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি বিদ্যমান অন্য সকল চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকার অনুমোদিত চার পদ্ধতির চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। যেমন- (১) অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থা (২) ইউনানী চিকিৎসা ব্যবস্থা (৩) আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং (৪) হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। তন্মধ্যে ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থায় মূলতঃ উদ্ভিজ্জ, প্রাণীজ, খনিজসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান, খাদ্য, পথ্য, আবহাওয়া পরিবর্তন এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের রোগ উপশম করা হয়। অল্টারনেটিভ চিকিৎসা পদ্ধতিতে চিকিৎসক প্রধানতঃ রোগীর আতœনিরাময় শক্তিকে পুনরুদ্ধার এবং তার শরীরের ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রোগ উপশমের লক্ষ্য নিয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন।

তবে উপরোক্ত তিনটি পদ্ধতি ছাড়াও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রকার অল্টারনেটিভ বা বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। যেমন- কাপিং থেরাপী, আকু প্রেসার, আকুপাংচার, লিচ থেরাপী, মেডিটেশন, রেজিমেন্টাল থেরাপী, মিউজিক থেরাপী, হাইড্রো থেরাপী, অ্যারোমা থেরাপী, সানবাথ, স্টিমবাথ, কায়রো-প্র্যাক্টিস, ব্যাচ ফ্লাওয়ার থেরাপী, হিপনো থেরাপী, ম্যাসাজ থেরাপী, রিফ্লেক্সোলজি, মাইন্ড-বডি থেরাপী, ইত্যাদি।

প্রশ্নঃ দেশে-বিদেশে অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনার ধারনা কী?
বিগত কয়েক দশকে অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থার ওষুধ উচ্চ শিখরে তার অবস্থান অধিষ্ঠিত করেছে। অল্টারনেটিভ চিকিৎসা পদ্ধতি প্রাগৈতিহাসিক কালের প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানের কষ্টি পাথরে যাচাই হয়ে সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বিগত কয়েক দশকে অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থা সারা বিশ্বে মহা আলোড়ন ও নবজাগরণ সৃষ্টি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) বিশ্বব্যাপী অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থার যৌক্তিক ব্যবহারের লক্ষ্যে এর পরবর্তী উন্নয়ন ও সম্প্রসারনকে জোরালো সমর্থন জানিয়েছে। তারা বলেছে এই ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই শাখাটি সবার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ক আমাদের কাংখিত লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং রাখবে। আজ তাই সচেতন জনগণঅল্টারনেটিভ ওষুধকে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য মনে করছে। তাই বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থার নবজাগরনের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশে অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থার শিক্ষা পদ্ধতির বর্তমান চিত্র সম্পর্কে আমাদের একটু বলুন।

ব্যাচেলর ডিগ্রী পর্যায়ের শিক্ষার বর্তমান চিত্র-
দেশে বর্তমানে ৮টি প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের অল্টারনেটিভ পদ্ধতির ব্যাচেলর ডিগ্রী প্রদান করছে। তন্মধ্যে ইউনানী/আয়ুর্বেদিক বিষয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রী প্রদান করছে ৪টি প্রতিষ্ঠান (যেমন- সরকারী ইউনানী এন্ড আয়ুর্বেদিক ডিগ্রী কলেজ, হামদর্দ ইনস্টিটিউট অব ইউনানী এন্ড আয়ুর্বেদিক মেডিসিন, রওশন জাহার ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজে ও হাসপাতার, লক্ষীপুর এবং হামদর্দ ইউনানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বগুড়া) এবং ৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির ব্যাচেলর ডিগ্রী প্রদান করছে।

ডিপ্লোমা পর্যায়ের শিক্ষার বর্তমান চিত্র-
দেশে ডিপ্লোমা ইউনানী মেডিকেল কলেজ ১৭ টি, ডিপ্লোমা আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ১০টি এবং ডিপ্লোমা হোমিওপ্যঅথিক মেডিকেল কলেজ ৫৯ টি রয়েছে।



বাংলাদেশে অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থার ওষুধ শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্তমান চিত্র-
দেশে অল্টারনেটিভ চিকিৎসা পদ্ধতিতে চিকিৎসকগণ উদ্ভিজ্জ, প্রাণীজ, খনিজ এবং অন্যান্য ওষুধি উপকরণ সমূহ ঔষধ হিসেবে মূলতঃ তিনভাগে ব্যবহৃত হয়ে করে থাকেন। যেমন- (১)ঔষুধি উপাদান সরাসরি ঔষধ হিসেবে। (২) আংশিক প্রক্রিয়াজাতকরণের পর ঔষধ হিসেবে এবং (৩) বিভিন্ন শিল্প কারখানায় ঔষধি উপাদানসমূহ সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত বিভিন্ন ডোসেস ফর্মের ঔষধ হিসেবে।বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪৫০টি ইউনানী/আয়ুর্বেদিক ঔষধ শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং হোমিওপ্যাথিক ল্যাবরেটরি রয়েছে প্রায় ১০০। যার মাধ্যমে সিরাপ, ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, অয়েন্টমেন্টসহ বিভিন্ন আধুনিক পরিবেশনায় ঔষধ উৎপাদন ও বিপণন হয়ে আসছে।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশে অল্টারনেটিভ চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের পেশাগত অবস্থার বর্তমান চিত্র কেমন?
দেশে বিভিন্ন সরকারী হাসপাতালে ২৫০ জনের মতো অল্টারনেটিভ উচ্চশিক্ষিত চিকিৎসক কর্মতর রয়েছে। এছাড়াও দেশের প্রায় ৫৫০টি অল্টারনেটিভ ওষুধ শিল্প প্রতিষ্ঠানে উক্ত অল্টারনেটিভ চিকিৎসকগণ ওষুধ উৎপাদনের সাথে জড়িত। হামদর্দ দেশব্যাপী প্রায় ৩০০ চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করেছে। এর প্রতিটিতেই অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থার (ইউনানী/আয়ুর্বেদিক) চিকিৎসকগণ চিকিৎসা সেবা প্রদান করছেন। এছাড়াও দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা কেন্দ্রে এবং ব্যক্তিগত চেম্বারে অসংখ্য অল্টারনেটিভ চিকিৎসক দেশব্যাপী রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন এবং উন্নত জীবন-যাপন করছেন।
ফলশ্রুতিতে বর্তমানে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীগণ অধিক হারে অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। তার এই পদ্ধতির শিক্ষা এবং গবেষণায় আতœনিয়োগ করছে। এইধারা চলতে থাকলে অচিরেই বাংলাদেশে অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থার অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হবে।

প্রশ্নঃ আপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের বলবেন কি অল্টারনেটিভ চিকিৎসায় কোন্ রোগসমূহে অধিক সফলতা পাওয়া যাচ্ছে, অর্থাৎ কোন্ রোগীরা চিকিৎসা গ্রহণের জন্য অধিক হারে অল্টারনেটিভ চিকিৎসকদের নিকট আসছেন?
অল্টারনেটিভ চিকিৎসকগণ তাদের প্রতিদিনের প্র্যাক্টিসে ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগে সাফল্যজনকভাবে চিকিৎসা প্রদান করছেন। রোগীগণও আস্থার সাথে ওষুধ সেবন করছেন এবং কোন প্রকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়াই উপকার পাচ্ছেন। এমতাবস্থায় অল্টারনেটিভ চিকিৎসায় কোনো বিশেষ রোগের ক্ষেত্রে বেশি নির্ভর করা উচিত সেভাবে বিষয়টি বলা কষ্টকর বলে আমি মনে করি।
তবে বর্তমানে পরিপাকতন্ত্র, শ্বসনতন্ত্র, হেপাটোবিলিয়ারি সিস্টেম, ইউরিনারি সিস্টেম, পুরুষ এবং স্ত্রী প্রজননতন্ত্র এবং অপুষ্টি ও বাত-ব্যথার রোগীগণ অধিক হারে অল্টারনেটিভ চিকিৎসকদের নিকট চিকিৎসার জন্য আসছেন এবং চিকিৎসা গ্রহণ করে ভাল ফলাফল পাচ্ছেন।

প্রশ্নঃ বর্তমানে অল্টারনেটিভ মেডিসিনের বিশ্ববাজার সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
বিগত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাপী হার্বাল ওষুধের এক নবজাগরণের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বর্তমানে সারা বিশ্বের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ কোন না কোন ভাবে হার্বাল ওষুধ ব্যবহার করছে। ১৯৮০ সালে হার্বাল মেডিসিনের বিশ্ববাজার ছিল ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৯০ সালে ১৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১০ বছরে প্রবৃদ্ধির হার ২৪৫%)। ২০০০ সালে ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১০ বছরে প্রবৃদ্ধির হার ৩৫১%)ও ২০১০ সালে তা বেড়ে দায়িয়েছে ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১০ বছরে প্রবৃদ্ধির হার ৪৭১%)।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে ২০৫০ সালে হার্বাল প্রোডাক্টের বিশ্ব বাজার দাঁড়াবে ৫ (পাঁচ) ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (৪০০ লক্ষ কোটি টাকা প্রায়)।(তথ্যসূত্র-ড. হাকীম রফিকুল ইসলাম)।এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্তমানে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, অ্যাজমা, ক্যান্সার, এইডসসহ বিভিন্ন জটিল ও কঠিন সংক্রামক ব্যাধির অল্টারনেটিভ ওষুধ উদ্ভাবনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে হার্বাল ঔষধ ইন্হেলার, ইন্জেকশন ও স্প্রে ইত্যাদি অত্যাধুনিক ফর্মের উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে।


প্রশ্নঃ বাংলাদেশে অল্টারনেটিভ মেডিসিনের বর্তমান ও ভবিষ্যত বাজার সম্পর্কে একটু বলুন?
কনভেনশনাল অ্যলোপ্যাথিক ওষুধের ব্যাপক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, ব্যয়বহুলতা এবং সহজলভ্য না হওয়ায় বর্তমানে মানুষ অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। পক্ষান্তরে অল্টারনেটিভ চিকিৎসা নিরাপদ, কার্যকরী, অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী মূল্য এবং সহজলভ্য হওয়ায় এটি মানুষের আস্থা ফিরে পেতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিশ্বের অসংখ্য দেশে অসংখ্য গবেষণাগারে এই ওষুধের উপর ব্যাপক গবেষণা শুরু হয়েছে। বর্তমানে অনেক জটিল ও কঠিন রোগের হার্বাল ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। বাংলাদেশেও হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনানী/আয়ুর্বেদিক ইনস্টিটিউট স্থাপনের মাধ্যমে গবেষণার নতুন দ্বার উন্মুচিত হয়েছে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা এই পদ্ধতির প্রতি আগ্রহী হচ্ছে, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ ও গবেষণায় মনোনিবেশ করছে। পাশাপাশি এই ব্যবস্থার ওষুধের গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আধুনিক ও উন্নত পরিবেশনায় ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। আমি আশাবাদি এই ধারা অব্যহত থাকলে অচিরেই দেশের চাহিদা পূরণ করে আমরা বিদেশে ওষুধ রপ্তানী করে একদিকে যেমন হাজার হাজার কোটি টাকার বিদেশী মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হবো, পাশাপাশি দেশের বেকারত্ব ও দারিদ্র দূরীকরণেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থা। বাংলাদেশে বিগত ১৯৮০ সালে ছিল ১ কোটি টাকা। ১৯৯০ সালে ৮ কোটি টাকা (১০ বছরে প্রবৃদ্ধি ৭০০%)। ২০০০ সালে ৮০ কোটি টাকা (১০ বছরে প্রবৃদ্ধির হার ৯০০%)। ২০১০ সালে বেড়ে দাড়ায় ১০০০ কোটি টাকা (১০ বছরে প্রবৃদ্ধি ১১৫০%)।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পূর্বাভাস মতে ২০৫০ সালে হার্বাল প্রোডাক্টের বিশ্ব বাজার দাঁড়াবে ৫ (পাঁচ) ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (৪০০ লক্ষ কোটি টাকা প্রায়)। আমরা যদি সেই সুযোগ গ্রহণ করতে পারি তবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২.৫% হারে বিশ্ব হার্বাল বাজারে নিজেদের শেয়ার নিশ্চিত করা গেলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশে হার্বাল প্রোডাক্ট দিয়ে ১০ লক্ষ কোটি টাকা আয় করতে পারবো।

প্রশ্নঃকি কি কারণে বাংলাদেশ অল্টারনেটিভ চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য অধিক সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে পরিগণিত?
বাংলাদেশের মানুষ বংশানুক্রমিকভাবেই অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল। যুগযুগ ধরেই আমাদের পূর্ব পুরুষগণ তাদের জটিল ও কঠিন সকল রোগব্যাধীতে অল্টারনেটিভ চিকিৎসাই গ্রহণ করে সুস্থতা লাভ করেছেন। এমনকি বিগত ৯০ এর দশকের পূর্ব পর্যন্ত যখন অ্যলোপ্যাথিক ঔষধ এতটা পরিচিতি পায়নি তখন পর্যন্তও অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থাই ছিল রোগ নিরাময়ের একমাত্র উপায়। এছাড়াও নি¤œলিখিত বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য অনেক সম্ভাবনাময় একটি দেশ। যেমন-
১। এদেশে রয়েছে ওষুধি উদ্ভিদের এক বিশাল প্রাকৃতিক ভান্ডার। বাংলাদেশে প্রায় ৫০০০ (পাঁচ হাজার) উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে বিভিন্ন রোগে কার্যকরী ১০০০ (এক হাজার) এরও অধিক মূল্যবান ওষুধি উদ্ভিদের এক বিশাল সম্ভার রয়েছে।
২। বাংলাদেশের ভূমি যথেষ্ট উর্বর এবং বৈচিত্রময় ঔষধি উদ্ভিদ চাষাবাদের জন্য আবহাওয়াও অত্যন্ত অনুকূল।
৩। আমাদের দেশে অন্যান্য দেশের তুলনায় উৎপাদন খরচ কম। কারণ এখানে অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায়।
৪। আমাদের দেশে উন্নতমানের হার্বাল ঔষধ তৈরী হয়, দেশে-বিদেশে যার ব্যাপক গ্রহণ যোগ্যতা রয়েছে।
৫। আমাদের দেশে চমৎকার বিধিবদ্ধভাবে ঔষধ প্রশাসনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাসায়নিক ঔষধের ন্যায় হার্বাল ঔষধ নিয়ন্ত্রণ হয়ে থাকে যা পৃথিবীর কম দেশেই বিদ্যমান।
৬। প্রচুর সংখ্যক শিল্পোদ্যোক্তা রয়েছে এদেশে, যারা অল্টারনেটিভ তথা হার্বাল মেডিসিনের গবেষণা, উন্নয়ন এবং উৎপাদনে বিনিয়োগে আগ্রহী।
৭। এদেশে কনভেনশনাল অ্যালোপ্যাথিক উচ্চশিক্ষিত চিকিৎসকগণ তাদের প্রতিদিনের প্র্যাক্টিসে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের পাশাপাশি অল্টারনেটিভ ওষুধও প্রেসক্রাইব করে থাকেন। রোগীরাও অধিক আতœবিশ্বাসের সাথে এই ওষুধ সেবন করেন।


প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন দেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই চিকিৎসা ব্যবস্থার কোনো সীমাবদ্ধতা আছে?
বাংলাদেশে অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। তথাপিও আমি মনে করি এই চিকিৎসা ব্যবস্থায় এখনো অনেক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যেমন-
* যদিও হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ-এ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল ইনস্টিটিউট স্থাপনের ফলে এই চিকিৎসা ব্যবস্থায় গবেষণা ও উচ্চ শিক্ষা লাভের নতুন দ্বার উন্মুচিত হয়েছে। তথাপিও বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থার যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে এবং ওষুধের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে সেই তুলনায় বাংলাদেশে অর্জিত অগ্রগতি পর্যাপ্ত নয়। অল্টারনেটিভ মেডিসিনের ক্রমবর্ধমান বিশ্ব বাজারে প্রবেশ করে এর সুবিধা ভোগ করতে চাইলে দেশে বিশেষতঃ সরকারিভাবে এই চিকিৎসা ব্যবস্থায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
* হামদর্দ কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার যথাযথ মান বজায় রেখেই শিক্ষা প্রদান করছে। এছাড়াও দেশে অল্টারনেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও যেন শিক্ষার মান বজায় রাখতে পারে সেই লক্ষ্যে সরকারিভাবে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতে হবে। শিক্ষকদের জন্য বেসরকারী স্কুল-কলেজের ন্যায় বেতন-কাঠামোর প্রক্রিয়া চালু করতে হবে।
* অল্টারনেটিভ চিকিৎসদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে হামদর্দ সাধ্যানুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে। দেশব্যাপী প্রায় ৩০০ চিকিৎসা কেন্দ্র, কারখানাসহ বিভিন্ন বিভাগ/সেকশনে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। সরকারীভাবে চাকুরীর কিছু সুযোগ সৃষ্টি হলেও এটি পর্যাপ্ত নয়। পাশাপাশি ডিপ্লোমা ডিগ্রীধারীদেরকেও সরকারী চাকুরীতে সুযোগ করে দিতে হবে।
* ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, অ্যাজমাসহ কিছু রোগের পর্যাপ্ত চিকিৎসা দিতে হলে ফর্মুলেশন উন্নত করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে ইন্হেলার, ইন্জেকশন ও স্প্রে ফর্মে হার্বাল ওষুধ উৎপাদন হলেও আমাদের দেশে এখনো সম্ভব হয়নি।
* আমাদের দেশে সম্প্রতি এই ব্যবস্থার ওষুধের চাহিদা যতটা বৃদ্ধি সাথে এর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত ওষুধি উদ্ভিদের উৎপাদন বাড়েনি। আমদানীর উপর অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ সরবরাহ সম্ভব হয়না। তাই দেশে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে ওষুধি উদ্ভিদের উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে।


প্রশ্নঃআপনার মতে অল্টারনেটিভ চিকিৎসা পদ্ধতির কোন কোন দিকে আরোও উন্নয়ন করা উচিত?
অল্টারনেটিভ চিকিৎসার উন্নয়নে নিম্মোক্ত বিষয়ে কাজ করা উচিৎ বলে আমি মনে করি-
১. এই পদ্ধতির শিক্ষার সম্প্রসারণ ও শিক্ষা কারিকুলাম পূণঃমূল্যায়ন ও আরোও উন্নয়ন করা প্রয়োজন।
২. সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার আরো অধিক সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
৩. ডিগ্রী অর্জনের পর অল্টারনেটিভ পদ্ধতির চিকিৎসকগণের কর্মসংস্থান নিশ্চয়ত করণের ব্যবস্থাকরা প্রয়োজন।
৪. সরকারী বিভিন্ন হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজসমূহে আরও অধিক হারে চাকুরীর সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার।
৫. দেশে ওষুধি উদ্ভিদ চাষাবাদের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত যাতে ওষুধি উদ্ভিদের জন্য বিদেশী
নির্ভরতা কমে এবং আরো সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ সরবরাহ প্রদান করা সম্ভব হয়।
৬. হাকীম, কবিরাজ, ফার্মাসিস্ট, বোটানিস্ট, কেমিস্ট, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং হার্বাল বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের
নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করা।

প্রাথমিক শিক্ষায় উন্নয়নের ধারা
                                  

আব্দুল্যাহ আল মামুন

এ অঞ্চলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয় ১৯১৯ সালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলে। তবে তখন প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পৌর এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৩০ সালে বেঙ্গল (রুরাল) প্রাইমারি এডুকেশন অ্যাক্ট প্রণয়নের মধ্য দিয়ে গ্রাম অঞ্চলের ৬ থেকে ১১ বছরের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা লাভের সুযোগ তৈরি হয়। এরপর ১৯৫১ সালে ব্রিটিশ-উত্তর পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদে পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প গৃহীত হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট কর্তৃক উত্থাপিত ২১ দফার মধ্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিশ্রুতির ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৯ সালের জাতীয় শিক্ষা কমিশন ১০ বছরের মধ্যে পাঁচ বছরমেয়াদি এবং ১৫ বছরের মধ্যে আট বছরমেয়াদি বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করে। উল্লিখিত কিছু পদক্ষেপ ছাড়া স্বাধীনতা-পূর্বকালে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা খাত ছিল একেবারেই অবহেলিত।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে রচিত ১৯৭২ সালের সংবিধানে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে স্থান দেওয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনা করেই বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন। ১৯৭৩ সালে একযোগে ৩৬ হাজার ১৬৫ প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রযাত্রার সূচনা করেন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গঠিত ‘কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন’ প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করার সুপারিশ করে। বঙ্গবন্ধুর গৃহীত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপগুলোর ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ প্রণীত হয়। ওই শিক্ষানীতিতে বলা হয়, ‘প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক এবং সবার জন্য একই মানের।’ এ নীতিতে শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং শিক্ষার উন্নয়নে করণীয় ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ আছে।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নে এবং প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের গৃহীত আরও পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে চার দফার প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন কর্মসূচির গ্রহণ। বছরের প্রথম দিনে শিশু শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া এ কর্মসূচির আওতায় অসাধারণ উদ্যোগ। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সব শিক্ষার্থীকে বছরের প্রথম দিনে পাঠ্যবই বিতরণ পৃথিবীতে নজিরবিহীন। এ কর্মসূচির অন্য উদ্যোগগুলো হলো শতভাগ উপবৃত্তি কার্যক্রম, অনগ্রসর এলাকায় স্কুল ফিডিং চালু, সরকারি বিদ্যালয়ে দপ্তরি-কাম-নৈশপ্রহরী নিয়োগ, খুদে ডাক্তার, স্টুডেন্ট কাউন্সিল গঠন, ই-মনিটরিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যালয় পরিদর্শন ইত্যাদি। উপবৃত্তির অর্থ ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের মোবাইল ফোনে সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছে। শিশু শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার মাধ্যমে মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ঘটাতে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালু ও সব বিদ্যালয়ে সুসজ্জিত প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষ প্রস্তুত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে একজন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকের নতুন পদ সৃষ্টিসহ প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ ও পুল শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বাড়তি ৩৭ হাজার ৭২৬ সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাইজেশন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করা, ঝরে পড়ার হার প্রায় শূন্যের কোটায় নিয়ে আসা, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সমতা আনা, নতুন শিক্ষাক্রমে নতুন পাঠ্যবই ছাপানো, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চালু, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ নানা ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে। প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (পিইডিপি-৪), জিপিএস, এনএনজিপিএস প্রজেক্টের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নতুন ভবন, ওয়াশ ব্লক, বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ, আসবাব ক্রয়, নিরাপদ খাবার পানির উৎস স্থাপনসহ ব্যাপক ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে স্কুল লেভেল ইম্প্রুভমেন্ট প্ল্যান (স্লিপ), প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার উপকরণ ও শ্রেণিকক্ষ সজ্জিতকরণ, বিদ্যালয়ের মেইনটেন্যান্স ও কন্টিজেন্সি বাবদ এবং স্কিমের আওতায় সরকারি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। সরকার ডিজিটাল কন্টেন্টের মাধ্যমে আনন্দঘন শিক্ষণ ব্যবস্থা চালুর জন্য বিদ্যালয়গুলোতে আইসিটি সামগ্রী হিসেবে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দেওয়া এবং শিক্ষকদের আইসিটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিটি উপজেলায় একটি করে বিদ্যালয়ে ওয়েল ইকুইপড ডিজিটাল স্মার্ট ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে।

শিক্ষার উন্নয়নে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা সবার ওপরে। ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি বর্তমান সরকার শিক্ষার মানোন্নয়নে যে কয়েকটি অসাধারণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এর একটি হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদটি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীতকরণ। সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেলও একধাপ উন্নীত করা হয়। বর্তমানে প্রধান শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১১ এবং সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১৩। এ ছাড়া ৩৪তম বিসিএস চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যারা ক্যাডার পাননি, তাদের মধ্য থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দ্বিতীয় শ্রেণির নন-ক্যাডার পদমর্যাদায় নিয়োগ করা হয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং গুণগত শিক্ষার ধারা নিশ্চিত করতে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে সরকার পর্যায়ক্রমে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। সম্প্রতি নতুন করে ৩৭ হাজার ৫৭৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকসহ আগের বেশিরভাগ শিক্ষকের স্নাতক বা তদূর্ধ্ব ডিগ্রি রয়েছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের মানও এরই মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষকদের পর্যায়ক্রমে দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, নিড বেজড সাব-ক্লাস্টার প্রশিক্ষণ, আইসিটি প্রশিক্ষণ, প্রধান শিক্ষকদের লিডারশিপ প্রশিক্ষণ ও ইংরেজি বিষয়ে দক্ষ করতে সরকারি অর্থায়নে ব্রিটিশ কাউন্সিল কর্তৃক মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষণসহ নানাবিধ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বিদ্যালয় পরিদর্শনকারী কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

রূপকল্প ২০৪১, স্মার্ট বাংলাদেশ এবং জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) বাস্তবায়নের জন্য মানবসম্পদ উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’-এর প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব শিশুর মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, যা অর্জনে বাংলাদেশ দৃঢ় অঙ্গীকার করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি ভিত্তির অন্যতম ভিত্তি ‘স্মার্ট নাগরিক’ তৈরির জন্যও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ও চিকিৎসার পাশাপাশি শিক্ষাকে মৌলিক প্রয়োজন হিসেবে স্বীকৃত দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, রূপকল্প ২০৪১, স্মার্ট বাংলাদেশ ও এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে সরকার উপর্যুক্ত যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছে। তথাপি, প্রাথমিক শিক্ষার সুষম উন্নয়নে কিছু অন্তরায় এখনো বিদ্যমান। সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে শিক্ষকদের আন্তরিকতা বাড়াতে এবং পেশাদারিত্বের মনোভাব তৈরি করতে হবে। শিক্ষকতাকে শুধু পেশা নয়, ব্রত হিসেবে গ্রহণ করলে সেই শিক্ষক কর্তৃক পুরো জাতি উপকৃত হবে। শিক্ষকদের পাঠাভ্যাসের অনীহা দূর করা প্রয়োজন। পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষা উপকরণ ও ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবহার করে শ্রেণি পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষকদের কার্যকর যোগাযোগের অভাব রয়েছে। পরিদর্শনে দেখা যায়, একজন শিক্ষক বাড়ির নিকটতম একই বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত আছেন এবং ব্যবসাসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকছেন। ফলে তিনি শিক্ষকতায় পরিপূর্ণভাবে মনোনিবেশ করতে পারছেন না। এ ছাড়া শিক্ষকদের পাঠদানের বাইরে অন্য কাজে সম্পৃক্ত করা থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিরত থাকতে হবে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাণিজ্যিকীকরণ মুক্ত করার মতো জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব প্রয়োজন। অভিভাবকদের অসচেতনতা, নিরক্ষরতা ও আর্থসামাজিক অবস্থা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের অন্যতম অন্তরায়। পিছিয়ে পড়া ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল প্রান্তিক পরিবারের শিশুদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও সচেতন থাকা প্রয়োজন। বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক গোষ্ঠী, অঞ্চল, জাতি, লিঙ্গ ও স্বাস্থ্যগত অবস্থানের সব শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।

সর্বোপরি, উল্লিখিত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সরকার কর্তৃক গৃহীত নীতি ও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সবার জন্য একই মানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে সব অংশীজনের সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন।

লেখক: যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহাম থেকে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ে মাস্টার্স

প্রত্যাশা: আত্মশুদ্ধির উদ্বোধন
                                  

মোছা: আয়েশা সিদ্দিকা (শিক্ষার্থী)

আত্মশুদ্ধির অর্থ আসলে আত্মার শুদ্ধি। নানা উপায় আত্মাকে শুদ্ধ রাখতে হয়। তা না হলে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠা হয় না। গবেষকরা বলে থাকেন, মানুষের শরীর অসুস্থ হলে যেমন চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তুলতে হয়, তেমনি আত্মা অসুস্থ হলে তাকেও পরিশুদ্ধ করে তুলতে হয়। কারণ আত্মা শুদ্ধ ব্যক্তিই পারে তার কর্মকাণ্ড দিয়ে চারপাশের পরিবেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে। আত্মা অশুদ্ধ থাকলে ব্যক্তির বাহিক আচার-আচরণ সহ তার কাজকর্মে অশুদ্ধতা ও অকল্যাণ নেমে আসে। মানব জীবনে তাই আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
আমরা আমাদের চারপাশে তাকালে দেখতে পাই, নানা অনাচারে ভরে উঠেছে সমাজ। কি ব্যক্তি জীবন? কি পারিবারিক জীবন? কি কর্ম জীবন? সর্বত্রই অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অনাচারে ছড়াছড়ি। কারণ কি? কারণ আমাদের মধ্যে আত্মশুদ্ধির অভাব।

পবিত্র ধর্ম গ্রন্থেও এ ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, `সে-ই সফলকাম হয়েছে, যে তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে এবং যে তার আত্মাকে কলুষিত করেছে সেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে আত্মাকে শুদ্ধ করা যায়? বিষয়টি দুইভাগে ব্যাখ্যা করতে পারি।

( ক) বর্জনীয়; যাবতীয় পাপ, অন্যায় ও অপবিত্র কাজ থেকে মুক্ত হওয়া অর্থাৎ যাবতীয় অসৎ গুণাবলী বর্জন করা। (খ) করণীয়; উত্তম গুনাবলী দ্বারা আত্মার উন্নতি সাধন করা অর্থাৎ প্রশংসনীয় গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে পরিত্যক্তিত অসৎ গুণাবলী শূন্যস্থান পূরণ করা।

বর্জনীয় ও করণীয়- এর চর্চার কাজটা শুরু করতে হবে নিজের ভেতর থেকে। তারপর পরিবার এবং কর্মক্ষেত্রে। কেননা অশুদ্ধ ও পচনশীল আত্মার বিষয়ে আমরা অভিমত-
` না উড়ে না পড়ে বোধ মহাকাল নেয় পঁচনশীল আত্মার শোধ
না ওড়ে না পোড়ে বোদ, মহাকাল নেবে অশুদ্ধ আত্মার শোধ`
(সম্ভবত ইহলোকেই এইসব দৃশ্যমান হয় কিংবা হবেই)
তাই প্রত্যাশা- আত্মশুদ্ধির উদ্বোধন হোক আমার, আপনার, আমাদের মাঝে।

গণহত্যার শিকারদের স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস
                                  

মো: জুবাইর: প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস হিসাবে পালিত হয়, যা গণহত্যার অপরাধ এবং এই অপরাধ প্রতিরোধের শিকারদের স্মরণ ও মর্যাদার আন্তর্জাতিক দিবসও।

১৯৪৯ সালের ৯ই ডিসেম্বরে প্রথমবারের মত জাতিসংঘে গণহত্যা প্রতিরোধ ও এ সংক্রান্ত শাস্তি বিষয়ক প্রথাটি গৃহীত হয়। এই দিবসের মূল লক্ষ্য হল গণহত্যা বিষয়ক প্রথাটির ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং গণহত্যায় মৃত ব্যক্তিদের স্মরণ ও সম্মান করা।
এই দিবসের মূল লক্ষ্য হল গণহত্যা বিষয়ক প্রথাটির ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং গণহত্যায় মৃত ব্যক্তিদের স্মরণ ও সম্মান করা। এটি জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে এ-ও স্মরণ করিয়ে দেয় যে তাদের নিজ জনগণকে গণহত্যার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য দায়িত্ব আছে। গণহত্যার উস্কানি বন্ধ করা ও গণহত্যা ঘটলে তা প্রতিরোধ করা এই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্ত জেলা কক্সবাজারে বিস্তীর্ণ শিবিরে বসবাসকারী রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা মুসলমানরা ১.২ মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা, যাদের অধিকাংশই ২৫শে আগস্ট, ২০১৭-এ মিয়ানমারে নৃশংস সামরিক দমনপীড়ন থেকে পালিয়েছিল, সচেতনতা বাড়াতে সমাবেশ করে দিনটিকে চিহ্নিত করেছে। তাদের দুর্দশার কথা এবং রাখাইন রাজ্যে তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অঙ্গীকারের কথা মনে করিয়ে দেয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, "গণহত্যা স্মরণ দিবস" স্মরণে রোহিঙ্গারা ৩৪টি ক্যাম্পের মধ্যে ১২টিতে সমাবেশ করেছে।
সমাবেশে, রাষ্ট্রহীন জনগণের সম্প্রদায়ের নেতারা রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বিশ্ব নেতাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
সমাবেশে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সাতটি দাবি তুলে ধরে, যার মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা গণহত্যার শিকারদের বিচার, নাগরিকত্বের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মিয়ানমারের বিতর্কিত ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বাতিল করা যা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে নাগরিকত্ব অস্বীকার করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, প্রত্যাবাসন, সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ। প্রত্যাবাসনের পর জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ধ্বংস এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
অনেক মানবাধিকার গোষ্ঠী হিংসাত্মক সামরিক দমন-পীড়ন থেকে বাঁচতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি ভারতের উদাসীনতাকে চিহ্নিত করেছে।
আনুমানিক ৪০,০০০ রোহিঙ্গা ভারতে রয়েছে, যাদের মধ্যে কমপক্ষে ২০,০০০ ইউএনএইচসিআর-এ নিবন্ধিত।
একইভাবে, ২০১৬ সাল থেকে, অতিজাতিবাদী হিন্দু গোষ্ঠীগুলি ভারতে মুসলমানদের উপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণের অংশ হিসাবে ভারতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের টার্গেট করেছে এবং তাদের দেশ থেকে বহিষ্কারের আহ্বান জানিয়েছে। অক্টোবর ২০১৮ থেকে, ভারত সরকার ১২ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে, দাবি করেছে যে তারা স্বেচ্ছায় চলে গেছে।
সহায়তা বাড়াতে জাতিসংঘের বিশেষ দূত: ঢাকায় জাতিসংঘের কার্যালয় থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে স্থানীয় গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত রোহিঙ্গা শরণার্থী ও আশ্রয়দাতা সম্প্রদায়ের প্রতি সমর্থন বাড়ানোর জন্য বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
“যেমন মহাসচিব এই গৌরবময় অনুষ্ঠানে পুনর্ব্যক্ত করেছেন, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অধিগ্রহণের পরে, মিয়ানমারে মানবিক, মানবাধিকার এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংকটের ব্যাপক, টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা এটিকে ভুলে যাওয়া সংকট হতে দিতে পারি না, "তিনি বিবৃতিতে বলেছিলেন।
তিনি যোগ করেছেন: "আমি এই অঞ্চলের দেশগুলির বৃহত্তর নেতৃত্বের জন্য বাংলাদেশকে সমর্থন এবং মিয়ানমারের সাথে তাদের প্রভাব কাজে লাগানোর জন্য শরণার্থীদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য সমর্থন অব্যাহত রাখব।"
বিশেষ দূত আরও জোর দিয়েছিলেন যে তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করা শেষ পর্যন্ত মিয়ানমারের দায়িত্ব।
তিনি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত করার হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবহারের ওপর জোর দেন।
এদিকে, বার্মা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক একটি পৃথক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে যে প্রায় ৬০০,০০০ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বৈষম্যমূলক আইন ও নীতির অধীনে আটকে আছে যা রাখাইন রাজ্যে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং চলমান গণহত্যার সমান।
“রোহিঙ্গা এবং বার্মার বাকি জনগণের দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে চাইলে বিশ্বকে সিদ্ধান্তমূলকভাবে কাজ করতে হবে,” বলেছেন অধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক কিয়াউ উইন

বিনোদনের নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকি
                                  

মোঃ আরিফ ঊল্লাহ

বিনোদন মানুষের আগ্রহের একটি কেন্দ্রবিন্দু। মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনের বিরক্তিকর রুটিন থেকে বের হয়ে নিজেকে অন্য এক জগতে নিয়ে যেতে চায়। পেতে চায় ভিন্ন রকম এক স্বাদ, যেখানে থাকবে না কোনো কাজের কিংবা পরিবারের চাপ এবং পাবে মানসিক প্রশান্তি। এই বিনোদনের জন্য এক এক মানুষের পছন্দ এক এক ধরণের। কেউ বিনোদন খোঁজে তার প্রিয় গায়কের গানে, কেউ তার প্রিয় লেখকের লেখায়, কেউ মিশে যেতে চায় প্রকৃতির মাঝে, কেউ তার আপন মানুষের সাথে আড্ডায় বা তার প্রিয় দলের খেলায়। যাই হোক আমরা যদি বিনোদনকে এক কথায় বলতে চাই তাহলে বলতে হবে, বিনোদন এমন এক ধরণের কাজ যা দেখে, শ্রবণ করে, ধারণা করে বা নিজে সেই কাজ করে আনন্দ পায়। আমার মতে বিনোদন হলো এমন কাজ যা মানুষকে আনন্দ বা মজা দেয়ার পাশাপাশি তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে সহায়তা করে, তাই বিনোদন।

বিনোদনের অনেক দিক রয়েছে। যেমন শরীর চর্চা, গল্পবলা, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, নাটক, কবিতা, বই, নৃত্য, কমিক নাটক, খেলাধুলা ইত্যাদি। বর্তমান সময়ে মানুষ কিছু বিষয়ে সিজনাল সমর্থক আবার কিছু বিষয়ে রেগুলার। যেমন আমরা অনেকেই নিয়মিত বই পড়ি কিন্তু কোনো উৎসবকে ঘিরে আমাদের সমর্থন সেই দিকে চলে যায়, এর সব থেকে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো “গ্রেটেস্ট শো অন দা আর্থ” বা ফুটবল বিশ্বকাপ। অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও খেলাধুলা নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই বরং এবার ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে আমাদের উম্মাদনা অন্য যেকোনো বিশ্বকাপের তুলনায় একটু বেশী বলেই মনে হচ্ছে। আমাদের ব্যবসায়ী ভাইয়েরা এই বিশ্বকাপকে ঘিরে তাদের জার্সি ও পতাকা বিক্রয়ের সন্তুষ্টি দেখেই বুঝা যায় খেলাধুলার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের উম্মাদনা কেমন, এমন কি অনেক বিক্রেতা জানায়, তারা ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী জার্সি দিতে হিমশিম খাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড স্পোর্টস ২৪ এর সূত্র মতে, বর্তমান সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে ফুটবল, প্রায় ৪ বিলিয়ন বা ৪০০ কোটি সমর্থক রয়েছে এই খেলায়, এর থেকেও মজার বিষয় হলো যে পরিমাণ মানুষ ক্রিকেট এর ভক্ত তার চেয়ে বেশী মানুষ প্রায় ২.৫ বিলিয়ন মানুষ ফুটবল খেলে থাকেন।

বিনোদনের কিছু নিয়ামক রয়েছে যা দর্শকের সন্তুষ্টি লাভে সহায়ক বা যে নিয়ামক সমূহ বিনোদনে থাকা খুবই জরুরী অথবা দর্শকমহলের উচিৎ এ সকল নিয়ামক তার বিনোদনে উপস্থিত আছে কিনা তা খুঁজে দেখা। যেমন বিনোদনের বিষয় টি কতটা বাস্তবসম্মত, বিনোদনের ধরণ বর্তমান পরিস্থিতিকে কতখানি প্রভাবিত করে, এই বিনোদন আপনাকে আপনার জীবনের গুরুত্ব বুঝাতে সক্ষম কিনা, আপনি এই বিনোদন থেকে কি শিখতে পারলেন, নতুন কোন বিষয়টি আপনি জানতে পারলেন ইত্যাদি। সর্বোপরি বিনোদন হবে সেই সকল কাজ যা আপনার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে সহায়তা করবে।
কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের উম্মাদনা এতোটাই বেশি যে, আমরা কোনো কিছু চিন্তা করতে চাই না, আমরা আবেগে ভেসেতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। হাজার ফুটের লম্বা পতাকা বানিয়ে রাস্তার পাশে ঝুলিয়ে রাখছি। জমি বিক্রি করে নিজ বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি পর্যন্ত পতাকা লাগানোর ঘটনাও ঘটাচ্ছি। কিন্তু দেশের মানুষ না খেয়ে শীতের রাতে রাস্তায় ঘুমাচ্ছে, বিকৃত পতাকা বানাচ্ছি আর অহংকার করছি কিন্তু পতাকার নামে যে অপমাননা করছি তার খবর কিন্তু কেউ রাখছি না। নিজ দলের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে বিশাল আকৃতির পতাকা টাঙ্গিয়েছি। কিন্তু আমার দেশের পতাকা সেখানে স্থান পায়নি, দলের সমর্থনে যা ইচ্ছে তাই বলছি এমনকি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ প্লেয়ারদের নিয়ে কটাক্ষ করতেও দ্বিধা করছি না। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে নষ্ট হচ্ছে অনেক ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব ও প্রিয়জনের সাথে গড়ে উঠা মধুর সম্পর্ক। দল যখন হেরে যায় তখন হয়তো ঘরবন্দি নয়তো মিথ্যে বা কাল্পনিক ফন্দি আড়তে থাকি। রাত বিরাতে এলাকায় আতশবাজি আর বিজয় মিছিল করছি। এতে করে এলাকাবাসীর যতই সমস্যা হোক তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। আমরা এতোটাই আবেগি যে, দলের জন্য জীবন দিতেও দ্বিধা করিনা। আর্জেন্টিনা প্রথম ম্যাচ পরাজিত হওয়ার পর কুমিল্লায় একজন মারা যায়। কেভিন ডেভিস নামক ৬৬ বছর বয়সী এক ওয়েলস সমর্থক মারা যায়। পতাকা টাঙ্গাতে গিয়ে কক্সবাজারে ২ জন কিশোর নিহত হয়। কিছু দিন আগে নেত্রকোনার শামিম মিয়াঁ নামে ২৮ বছর বয়সের একজন হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়। বিগত বছরগুলো বিবেচনা করলে দেখা যায় ১৯৬৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৩ শত ছাব্বিশ জন সমর্থক গাদাগাদি, হুড়োহুড়ি এবং পদদলিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এরমধ্যে সর্বাধিক করুণ ঘটনা টি ঘটে ১৯৬৪ সালে পেরুতে। যেখানে প্রায় ৩২০ জন মারা যায় এবং ২০০১ সালে ১২৬ জন ঘানায়। এছাড়াও চলতি বছরে ইন্দোনেশিয়ায় ১২৭ জন সমর্থক স্টেডিয়ামে পদপিষ্ট হয়ে মারা যায়।

এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সর্বপ্রথম আমাদের নিজেদেরকে সচেতন হতে হবে। আবাসিক এলাকার বাহিরে বিজয় উৎসব পালন করতে হবে। খেলার মধ্যে হার জিত অবশ্যই থাকবে এবং একথা মেনে নেয়ার মতো মানসিকতা থাকতে হবে। অতি আবেগি হওয়া যাবে না, কারো সাথে তর্কে জড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। সকল দলের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। বিনোদনকে ব্যবহার করে অন্যকে হেয় করা যাবে না। কাজ করার পূর্বে এর ফলাফল কি হতে পারে তা নিয়ে ভাবতে হবে। মানবিক মানসিকতা পোষন করতে হবে। দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা লালন করতে হবে। কোনক্রমে বিনোদন যেন ক্ষতির কারণ হতে না হয়, এই দিকটি বিশেষভাবে খেয়াল করতে হবে। মনে রাখতে হবে খেলা কেবল মাত্র একটি বিনোদন, আর বিনোদন আপনার জন্য, বিনোদনের জন্য আপনি নন।
লেখকঃ মোঃ আরিফ ঊল্লাহ
উন্নয়ন কর্মী, কোস্ট ফাউন্ডেশন
Email: [email protected]

ভারত ও বাংলাদেশের উচিত তিস্তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করা
                                  

বিশেষ সংবাদদাতা: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর একটি হলো তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে আলোচনা চলছে। কিন্তু আশ্বাসে থেমে গেছে তিস্তা ইস্যু। ১৯৯৬ সালে গঙ্গা চুক্তির পর তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯৮৩ সালের আগস্ট মাসে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি শুরু হয়।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা সফর করেন। সে সময় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। অন্তর্র্বতী চুক্তির মেয়াদ ছিল ১৫ বছর। চুক্তি অনুযায়ী তিস্তার পানির ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশের ওপর ভারতের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার কারণে চুক্তি চূড়ান্ত হয়নি।
পরবর্তীতে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। এই ভারত সফর তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের আশা জাগিয়েছে। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু তারপরও রাজি হননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, তার মতবিরোধের মূল কারণ উত্তরবঙ্গের মানুষকে বঞ্চিত করে তিনি বাংলাদেশকে পানি দিতে রাজি নন। এমনকি ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ঢাকা সফর করেছিলেন। সে সময় তিস্তা চুক্তি নিয়ে ইতিবাচক বক্তব্য দেওয়া হলেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী বা অভিন্ন নদী রয়েছে। এর মধ্যে ৪৩টি অভিন্ন নদীর পানির বেশির ভাগই ভারতের দখলে, যা প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি কার্যত অন্যায্য। ৫৪টি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের কারিগরি কমিটি ৫ জানুয়ারী, ২০২১ থেকে দুই দিনের জন্য বৈঠক করেছে। করোনভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বৈঠকটি কার্যত শেষ হয়েছে। বৈঠকে অভিন্ন নদীতে পানি বণ্টনের জন্য একটি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়। এর আগে, বাংলাদেশ সরকার ত্রিপুরার সাব্রুম শহরে পানি সংকট মোকাবেলায় মানবিক কারণে ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি তুলতে সম্মত হয়। তবে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি দিনের পর দিন অমীমাংসিতই থেকেছে। একটি আন্তঃসীমান্ত নদী জুড়ে জল ভাগাভাগির ক্ষেত্রে চুক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এটি একটি দেশের জল ভাগ এবং প্রাপ্যতা নিশ্চিত করেছিল। চুক্তি সম্পন্ন না হলে সাব্রুম শহরে এমনকি বাংলাদেশেও পানির ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে না, পাম্প হাউস দিয়ে সেচ প্রকল্প নির্মাণ করে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। চুক্তির ফলে উভয় দেশই লাভবান হবে। গজলডোবা বাঁধটি ১৯৯৮ সালে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার মহকুমায় নীলফামারীর তিস্তা নদীর উজানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে তিস্তা নদীর নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে চলে যায়। বাঁধের ৫৪টি গেট রয়েছে যা তিস্তার মূল স্রোত থেকে বিভিন্ন সেক্টরে পানি সরানোর জন্য বন্ধ রয়েছে। বাঁধটি মূলত তিস্তার পানি তিস্তা-মহানন্দা খালে প্রবাহিত করার জন্য নির্মিত হয়েছিল। গজলডোবা বাঁধের আগে তিস্তা অববাহিকায় ২৫০০ কিউসেক পানি পাওয়া যেত, এখন পানির প্রবাহ ৪০০ কিউসেক কম। বাংলাদেশে ১৯৯৭ সালে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানির প্রবাহ ছিল প্রায় ৬,৫০০ কিউসেক, যা ২০০৬ সালে ১,৩৪৮ কিউসেকে নেমে আসে এবং ২০১৪ সালে তা দাঁড়ায় মাত্র ৮০০ কিউসেকে। পানির অভাবে অনেক জমি চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ফলে সাধারণ কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, যার প্রভাব পড়ছে তাদের জীবিকা। অপর্যাপ্ত পানির প্রবাহে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে চরগুলোতে। গ্রীষ্মকালেও নদীতে একেবারেই পানি থাকে না। মানুষ পায়ে হেঁটে নদী পার হয়। মরা নদীতে পরিণত হয়েছে তিস্তা। এভাবে চলতে থাকলে শুধু জনজীবনই নয়, জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়বে। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এখন সময়ের দাবি। কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির ব্যাপারে ভারতের দেরি বোঝায় যে তারা এটা মানতে নারাজ। তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটার খনন করবে। খননের মাধ্যমে নদীর গভীরতা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। নদী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অনেক নদী উদ্ধার করা হবে। নদীর তীরবর্তী জমি চাষের উপযোগী করা হবে। এমনকি তিস্তা নদীর উভয় তীরে শিল্পনগরী গড়ে তোলা সম্ভব হবে, যা বহু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এতে দেশের সমগ্র অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। মূলত, তিস্তা নদী চুক্তি স্বাক্ষর না করা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রতিবেশী মনোভাবকে ক্ষুণ্ন করছে। ভারতের মনে রাখা উচিত বাংলাদেশ এই অঞ্চলে একটি বিশ্বস্ত মিত্র। ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর না করলে বাংলাদেশ অবশ্যই বিকল্প পথ খোঁজার চেষ্টা করবে। প্রায়ই বলা হয় বাংলাদেশ ও আমি হফরধ বর্তমানে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্বর্ণযুগের সাক্ষী। বাংলাদেশ ইস্যুতে চীনের সহযোগিতা গ্রহণ করার আগে ভারতের উচিত বিরোধ নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ হতে সম্মত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা এখনও ভারতকে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী এবং মিত্র হিসাবে বিবেচনা করে।
ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণে শেখ হাসিনা তিস্তা নদীর বণ্টন সমস্যা সমাধানে আগ্রহী। তবে ভারতের পক্ষ থেকে দেরি হলে বিকল্প পথের কথা ভাবতে পারে বাংলাদেশ। তিস্তা সমস্যার ফলপ্রসূ সমাধান শুধু বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত করবে না বরং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করতেও সাহায্য করবে। তিস্তা চুক্তি ভারতকেও দারুণভাবে উপকৃত করবে। এই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এগিয়ে গেলে তা বাংলাদেশের সকল স্টেকহোল্ডারদের সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হবে। ভারত অবশ্যই বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী মিত্র হিসেবে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করতে এবং একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
তিস্তা নদীর রয়েছে অপার সম্ভাবনা। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি বা তিস্তা প্রকল্পের যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে শুধু তিস্তা উপকূল বা উত্তরবঙ্গের মানুষ নয়, সমগ্র বাংলাদেশ এর সুফল ভোগ করবে। পরিবর্তন আসবে উত্তরবঙ্গের জনজীবনে। বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। সব মিলিয়ে তিস্তা চুক্তি বা তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

ভারত সীমান্তে বেআইনি হত্যাকাণ্ড: বিচার চাইছে বাংলাদেশি পরিবার
                                  

বিশেষ সংবাদদাতা: পরিবারগুলো তাদের দড়ির শেষ প্রান্তে! তারা কয়েক দশক ধরে ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত বাংলাদেশী বেসামরিক নাগরিকদের "বেআইনি হত্যার" বিচার দাবি করে আসছে। একটি স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন অধিকার দাবি করেছে যে গত দুই দশকে ভারতীয় বাহিনীর হাতে সীমান্তের ওপারে ১,২০০ জনেরও বেশি বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিক। ঐতিহাসিক বন্ধু হিসেবে বিবেচিত তার প্রতিবেশী সীমান্ত বাহিনী কর্তৃক বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষও অনেকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কয়েকদিন আগে ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ বুধবার রাত ১১টার দিকে দাইনুর সীমান্তের ৩১৫ নম্বর পিলারের কাছে এ ঘটনায় আরো দুজন নিখোঁজ হয়।

নিহত মিনার (১৮) উপজেলার খানপুর এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীরের ছেলে। নিখোঁজরা হলেন একই এলাকার লতিফুলের ছেলে এমদাদুল (২৮) ও সালমানের ছেলে সাগর (২০)। স্থানীয়রা জানান, প্রায় পাঁচজন শুঁটকি মাছ আনতে সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে ফেরার সময় বিএসএফের একটি টহল দল তাদের দেখতে পায়। বিএসএফ সৈন্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালালে মিনার ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। এ সময় আরও দুইজন নিখোঁজ হন। দাইনুর বিপিও নায়েক সুবেদার আক্তার হোসেন জানান, ভারতীয় ভূখণ্ডের দক্ষিণ দিনাজপুর এলাকায় লাশটি পড়ে ছিল যা পরে উদ্ধার করা হয়।
সাম্প্রতিক অতীতে আনাদোলু এজেন্সির সাথে কথা বলার সময়, বাংলাদেশী আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ পরামর্শ দিয়েছেন যে সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বাংলাদেশের উচিত ভারতীয় নাগরিক সমাজ এবং মানবাধিকার কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করা এবং উভয় সরকারকে আলোচনায় বসতে এবং এই গুরুতর সমস্যাটির সমাধান করার জন্য চাপ দেওয়া উচিত।
"যদি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মিডিয়া এই মানবিক ইস্যু সম্পর্কে ভারতীয় জনগণ এবং সুশীল সমাজের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে সক্ষম হয়, তবে এটি সীমান্ত হত্যা শূন্যে নিয়ে আসার জন্য ভারত সরকারের উপর জোরালো চাপ সৃষ্টি করবে," আহমেদ জোর দিয়েছিলেন।

 

নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে কে?
                                  

মোঃ আরিফ উল্লাহ

স্বাধীনতার অর্ধশতক পরেও যেন লাল-সবুজের এই দেশ পরাধীন। স্বাধীন দেশে বসবাস কিন্তু স্বাধীনতার অর্থ যেন আজও অজানা। এখনও বাংলার নারী তথা আমার আপনার মা, বোন স্বাধীনভাবে চলাচলের স্বাধীনতা পায়নি, পায়নি পরিপূর্ণ বাকস্বাধীনতা। এখনও প্রায় প্রতি মুহূর্তে দেশের কোথাও না কোথাও ঘটে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন। মানুষ নামের হায়েনারা ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে। দেশকে নিয়ে যাচ্ছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে, এ মানুষ নামের পশুগুলিকে পশু বললে পশুকে অপমান করা হবে এরা তো অবুঝ হিংস্র প্রাণীর চেয়েও বদতর। বলছি ধর্ষকের কথা যারা মানুষ রুপী নরপশু। আর এ ধর্ষকেরা সমাজ, দেশ ও সমগ্র মানব জাতীর জন্য কলঙ্ক।একটি দেশকে শত বছর পিছিয়ে নেয়ার জন্য এ ধর্ষকেরাই যথেষ্ট।

যে শিশুদের উপর নির্ভর করছে আগামীর ভবিষ্যৎ,এই শিশুরা যদি নসিক,শারীরিক,যৌন ও অন্যান্য অত্যাচারের শিকার হয়, এমন পরিবেশে বেড়ে উঠে, তাহলে তাদের নিকট থেকে ইতিবাচক কিছু আশা করা নিছক বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। আর যে নারীকে জাতি গড়ার কান্ডারী বলা হয় সেই নারী যদি প্রতি ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয় তবে সেই নারী জাতি গঠনে কতখানি ভূমিকা রাখতে পারবে তাও প্রশ্নবিদ্ধ।

বর্তমানে ধর্ষনের চিত্র দেখলে শরীর শিহরিয়ে উঠে। প্রশ্ন জাগে লাখো শহিদের আত্মত্যাগের সাথে আমরা কতখানি ব্যবিচার করছি? কি পরিমান অন্যায় করছি সেই মানুষটির সাথে যিনি তার জীবনের প্রতি টি ক্ষণ উৎসর্গ করেছেন এবং স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি সোনার বাংলাদেশের। তিনি হচ্ছেন আমাদের সবার প্রিয় নেতা আত্মত্যাগী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তবে কি আমরা এই অদম নরপশুদের কাছে হেরে যাবো? ১৬ কোটি মানুষ কি তাহলে এই নরপশুদের সামনে অসহায় হইয়ে পড়েছে? কিন্তু বাঙ্গালী জাতি তো হারতে শিখেনি। আমরা জয় করতে শিখেছি, বিজয় ছিনিয়ে আনতে শিখেছি, শিখেছি নিজের অধিকার আদায় করতে। তবে আজ কেন আমরা অসহায়ের মতো আচরণ করছি? কেন আমরা আজ নিশ্চুপ? এর প্রধান কারন আমরাই। কারন আজ আমারা আত্মকেন্দ্রিক। আমাদের মধ্যে দিন দিন দেশপ্রেম হারিইয়ে যাচ্ছে। বাঙ্গালীয়ানা আমাদের সমাজ থেকে লোপ পাচ্ছে। আমরা এখন ব্যস্ত ওয়েস্টার্ন কালচার নিয়ে, আমরা এখন যৌথ পরিবার ভেঙ্গে আলাদা থাকতে পছন্দ করি, নিজের স্বার্থ আদায় করতে ব্যস্ত থাকি, অন্যের দূরাবস্থায় নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করি, সহযোগিতার পরিবর্তে মোবাইলে ভিডিও করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, তাই বর্তমান সময়ে আত্মত্যাগী মানুষ খোঁজে পাওয়া আজ বড় দুষ্কর, এবং এর ফল স্বরূপ ধর্ষনের মতো সামাজিক ব্যাধি, যার কাছে আমরা আজ অসহায় হইয়ে পড়েছি। আর নয় আত্মকেন্দ্রিকতা এবার জেগে উঠার পালা। আমাদেরকে ৭১ এর বীর সৈনিকদের ন্যায় অস্ত্র হাতে নিতে হবেনা, হবেনা কোনো বিশাল সৈনিকের বহরের বিপরীতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। শুধু একটু সচেতন হতে হবে। অন্যায়কে “না” বলা শিখতে হবে। অন্যায় দেখলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কে অবহিত করতে হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মনোভাব তৈরি করতে হবে এবং যার যার ধর্মকে শ্রদ্ধার সাথে অনুসরন করতে হবে। তবেই আমাদের শিশু ও মা বোনেরা স্বাধীন ও মুক্ত ভাবে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে।
যদি বিগত কয়েক বছরের নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র দেখি তাহলে দেখা যায়, বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন এর তথ্যমতে ১০বছর পূর্ন হওয়ার আগেই দেশের ৫.১৭ শতাংশ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ৮০.২ ভাগ নারী কোনো না কোনো সময় আর্থিক , মানসিক, যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। অন্যদিকেবাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও মানবাধিকারকর্মী সালমা আলীর তথ্য মতে ২০২১ সালে বাল্যবিবাহের হার পূর্বের তুলনায় ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ২০ হাজার শিশু ও নারী পাচার হয়। এসময়ে ১ হাজার ২৫৩ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যেখানে ধর্ষণের পর ৪৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। শুধু তাই নয় ২০২১ সালে প্রায় ১৯ হাজার নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত মামলা হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এ নরপশু ধর্ষকদের কাছে ফুলের মত নিষ্পাপ শিশু আর প্রাপ্ত বয়স্ক কোনো ভেদাভেদ নেই। এর সাথে এদের অত্যাচারের মাত্রা আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এতোটাই অমানসিক নির্যাতন করে যা আমরা কল্পনায় ভাবতেও ভয় পাবো। দিন টি ৩০ জুলাই ২০১৭, ৩৫ বছর বয়সি সিপন, চার বছরের এক শিশুকে ধর্ষন করে এবং ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুটি মৃত্যু্র কুলে ঢলে পড়ে। গত ২৫ আগূপা, রুপা বগুরা থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে তাকে ধর্ষন করা হয়।২৬ মার্চ ২০১৮ কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলায় ৫ বছরের এক কন্যা শিশুকে ধর্ষণ করা হয়। আর সবুজ ঘাসের উপর পরে থাকা বিউটির লাশ যেন চিৎকার করে বলছে, "হে বাঙ্গালী আর ঘুমিয়ে থেকোনা। জেগে উঠো, নয়তো লাল সবুজের পতাকার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।" কি এমন অন্যায় করেছিল রূপা বা বিউটি? কি দোষ করেছিল ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশু গুলি যার শাস্তি হিসেবে এমন করুন পরিনতির শিকার তারা?

রূপা হয়তো তার পরিবারের মধ্যমণি ছিল। চার বছরের শিশুটি কে তার মা কোলে তুলে গল্প শুনিয়ে নিজ হাতে খাওয়াবে বলে হয়তো সেই দিন ও বসে ছিল।বাবা ও হয়তো তার রাজকন্যার জন্য সেই দিন ও সারপ্রাইজ গিফট কিনবে বলে ভেবেছিল কিন্তু তা আর হইয়ে উঠেনি, এক হায়েনার নির্মম অত্যাচারে শিশুটির জীবনের ইতি ঘটলো।এভাবেই প্রতি দিন কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো মা হারাচ্ছে তার সন্তান, ভাই হারাচ্ছে তার বোন, একটি পরিবার হারাচ্ছে তার হাসি খুশির মধ্যমণিকে, এবং এ হারানোর বেদনা সেই মায়ের থেকে বেশি কেউ বুঝবে না যে মা তার শিশু সন্তান কে হারিয়েছে।শুধু একটি জীবনের ইতি ঘটেনি, ইতি ঘটেছে একটি স্বপ্নের, একটি প্রতিভার, একটি বিশ্বাসের এবং অবিশ্বাসের জন্ম হইয়েছে এ দেশের প্রতি সাথে মানব জাতীর প্রতি। এ ব্যাধি নিরসনে বর্তমান সরকারকে এখনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় আমাদের সকল অর্জনকে বিলীন করার জন্য “ধর্ষণ “ নামক সামাজিক ব্যাধিটিই যথেষ্ট। অতি শিগ্রই সকল সামাজিক ব্যাধির প্রকোপ থেকে দেশ রক্ষা পাবে, আর কোনো ধর্ষনের মতো নিকৃষ্ট ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবেনা এই কামনা করি। আমাদের শিশুরা বেড়ে উঠবে বাদভাংগা আনন্দে ,আমাদের মায়েরা গড়বে এক বলিষ্ঠ জাতি।

লেখক :
মোঃ আরিফ উল্লাহ, উন্নয়ন কর্মী
Email: [email protected]

বন্ধুত্বই গড়বে সম্প্রীতির বাংলাদেশ
                                  

রাহাত হুসাইন :

মানব সমাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নাম হচ্ছে বন্ধুত্ব। রক্তের সম্পর্কের বাহিরে গিয়ে, আস্থা-বিশ্বাস ও স্নেহাস্পদ হচ্ছে এ সম্পর্কের ভিত্তিমূল। আত্মার সঙ্গে আত্মার শক্তিশালী বন্ধনের মধ্য দিয়েই এ সম্পর্কের ভিত্তি আরও মজবুত হয়। ধন-দৌলত, টাকা-পয়সা দিয়ে বন্ধুত্বের মূল্যায়ন হয় না। বন্ধুত্বে টাকা-পয়সা নগণ্য বিষয়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা, ধর্ম-বর্ণের মানুষজন আমাদের সমাজে বাস করেন। তাদের সঙ্গেই আমাদের চলাফেরা, ওঠাবসা আর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে। সমবয়সী, প্রতিবেশী, সহপাঠী, অফিসের সহকর্মীদের মধ্যেই আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এমকি একই আদর্শ ও  চিন্তা-ভাবনার লোকজনের মধ্যেও বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে।
প্রতিনিয়ত বিশ্বজুড়ে বন্ধুরা গড়ছে নিত্যনতুন ইতিহাস। সৎ-মননশীল চিন্তা ও কর্ম উদ্যোগ থাকলে বন্ধুরা মিলে যেকোনো কাজেই সফলতা লাভ করতে পারে। বন্ধুত্বের সলতাই ছড়াতে পারে সম্প্রীতির আলো। দেশে যখন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস চোখ রাঙাচ্ছে, সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মালম্বীদের ঘর-বাড়ী ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা হচ্ছে, ঠিক  তখনই সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে আসলো বিশ্ব বন্ধু দিবস-২০২২।প্রাচীনকাল থেকেই বাঙলায় নানা জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্ম-বর্ণের মানুষজন পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে বসবাস করছেন। একে অপরকে শ্রদ্ধাবোধের মধ্য দিয়েই  আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির বজায় রেখে চলছে। সম্প্রীতি বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য। বাঙালিরা সবর্দা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে। তবুও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দেশে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধাতে ফাঁক-ফোকর খোঁজে। হিংসা ছড়িয়ে দিয়ে সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায়। শান্তিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়। সহিংস পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও বন্ধুত্ব নষ্ট করতে একটি চক্র প্রতিনিয়ত অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির পায়তারা করছে। মানুষ ও মনুষত্বের উপর আঘাত করছে। মানবতা ভূলন্ঠিত হচ্ছে।
ইসলাম ধর্মের প্রাণপুরুষ প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স)’কে অবমাননা করে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে।  আরেকটি চক্র এই তথ্যটি যাচাই-বাছাই না করেই উন্মাদনা সৃষ্টি করে, আইন নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির আধুনিক যুগেও বাঙালি মুসলিমদের একটা অংশ হুজুগে থাকে। তথ্যের সততা নিশ্চিত না হয়েই ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে, দলবদ্ধ হয়ে হামলা করে সনাতন ধর্মালম্বীদের ঘর-বাড়ী, দেব-দেবীর মূর্তি ও পূজারস্থানে ভাঙচুর চালায়।  সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে সাম্প্রদায়িক নিপিড়ন করে। আবার এর ফাঁকে কেউ কেউ লুটে নিচ্ছে অর্থ-কড়ি ও মূল্যবান জিনিসপত্র। রক্ষা পাচ্ছে না সনাতন ধর্মের নারী, শিশুরাও। আগুন লাগিয়েও তাদের সমুদয় সম্পদ জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। বে-ঘর করা হচ্ছে সংখ্যালঘু জাতিগত সম্প্রদায়কে। সাম্প্রদায়িক অশুভ চেতনা আমাদের সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। সুযোগ পেলেই ছোবল মারে। আসলে হিন্দু হোক বা মুসলমান, সাধারণ মানুষ প্রকৃতপক্ষে অ-সাম্প্রদায়িক। তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে দেয় ধুরন্ধর শয়তানরা।
সমাজ থেকে সাম্প্রতিক অপশক্তি রুখার পথ কি? একমাত্র বন্ধুত্বই পারে সাম্প্রদায়িকমুক্ত সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়তে। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস মোকাবিলার অন্যতম উপায় হচ্ছে বন্ধুত্ব। আমাদের সমাজের সকল শ্রেণি-পেশা ও ধর্ম-বর্ণের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক আরও দূঢ় করতে হবে। চিন্তার জগতের আমূল-পরিবর্তন করতে হবে। দেশের সমৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের মানবিক সমৃদ্ধি গঠনেও কাজ করতে হবে। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের মাঝে মায়া-মমতা, সহমর্মিতা, সমবেদনা আর বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করা। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি দরদী হওয়া। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নয়, আমরা সবাই মানুষ; মহান স্রষ্টার শ্রেষ্ট সৃষ্টি, এই চেতনা ধারণা করা। ধর্মের সঠিক ব্যাখা ও তথ্যউপাত্ত প্রচারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
ঘরে-ঘরে বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। একে অপরের বিপদ আপদে পাশে দাঁড়াতে হবে। আজ চিকিৎসা বিজ্ঞান আর জীবনের প্রয়োজনে হিন্দু-মুসলমানের রক্ত আদান-প্রদান হচ্ছে। মুসলিমদের শরীরে বইছে হিন্দুর রক্ত। আবার হিন্দুর শরীরে বইছে মুসলিমদের রক্ত। ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে রক্তের সঙ্গে রক্তের বন্ধন তৈরি হচ্ছে। এই বন্ধনকে আরও মজবুত করা প্রয়োজন। মানুষের মঙ্গলের জন্য ধর্মের সঠিক ব্যাখা ও তথ্য-উপাত্ত প্রচার করার জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ধর্মীয় পন্ডিতদের উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি বন্ধুত্বের শক্তি কাজে লাগিয়ে সম্প্রীতির বাংলাদেশ নির্মাণের পথে এগিয়ে যেতে হবে। দেশের প্রতিটি পড়া-মহল্লায় সব ধর্মের বন্ধুরা ঐক্যবদ্ধ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। বিদ্যার্থীদের শ্রেণিকক্ষেই দিতে হবে সম্প্রীতির শিক্ষা। প্রতিটি ধর্মের পন্ডিত ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে গ্রাম-গঞ্জের সর্বত্র মাসে একবার হলেও সম্প্রীতির সভা করতে হবে। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা বেশি। ইসলামসহ সকল ধর্মই মানুষের কল্যাণের কথা বলেছে। কোনো ধর্মই মানুষে-মানুষে দাঙ্গা হাঙ্গামা চায় না। মানুষের অমঙ্গল চায় না। ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম। ইসলাম কখনও অন্য ধর্মের মানুষের উপরে আঘাত করতে বলে না। বরং ইসলাম সব সময় সহবস্থানের কথা বলে। ইসলাম প্রতিবেশী বন্ধুর অধিকার রক্ষার কথা বলে। ইসলাম মানুষের সঙ্গে সর্বোত্তম আচরণের কথা বলে। দেশে যারা ধর্মকে পুঁজি করে অন্য ধর্মের মানুষের ওপরে হামলা করবে বন্ধুরা সবাই মিলে সেই ইবলিশ- অসুরদের প্রতিহত করতে হবে। গ্রিক দর্শনিক মহামতি প্লেট বলেছেন `বন্ধুদের মধ্যে সবকিছুতেই একতা থাকে’। বন্ধুত্বের ঐকবদ্ধ শক্তিই সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মোকাবিলায় কাজ করতে হবে। নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের কঠোর থেকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে । আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতিতে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মাঝে সৌহার্দ ও সম্প্রীতির বন্ধন চীর অটুট রাখতে হবে। এবারের বন্ধু দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক, সম্প্রীতির বাংলাদেশ নির্মাণে সব ধর্মের বন্ধুরা হাঁটবো এক সঙ্গে। বন্ধুত্বের সুর দূর করবে সকল অসুর। বন্ধুত্বের জয় হোক, মানবতার জয় হোক, জয়বাংলা।


লেখক-সাংবাদিক ও সংগঠক

E-mail: [email protected]

বানালিটির কুফল এবং এর পরে যা হয়
                                  

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: বিভিন্ন সংঘী এবং মন্ত্রীদের দ্বারা করা অযৌক্তিক এবং হাস্যকর বিবৃতিগুলিকে উপহাস করা উচিত নয় কারণ তারা শেষ পর্যন্ত নীতিতে পরিণত হয়।

কি হাস্যকর মানুষ হয়ে গেছি আমরা। এখানে আমাদের চারপাশের অযৌক্তিকতার একটি নমুনা রয়েছে – একটি টিভি চ্যানেল দাবি করেছে যে আসামে বন্যা সৃষ্টিকারী একটি বাঁধ মুসলিম সন্ত্রাসীরা একটি `বন্যা জিহাদের` অংশ হিসাবে লঙ্ঘন করেছিল, অন্যান্য মিডিয়া ব্যক্তিরা এটি টুইট করেছেন এবং রাহুল সাগর, যিনি ভারতীয় জনতা পার্টির পরিচালনা করেন। (বিজেপি) ওবিসি সোশ্যাল মিডিয়াও এটিকে সমর্থন করেছে। সরকার কথিত লঙ্ঘনের অভিযোগে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে, সমস্ত মুসলিম।
জাতীয় শিক্ষা নীতির কর্ণাটক টাস্ক ফোর্সের প্রধান, মদন গোপাল বলেছেন যে উভয়ই প্রস্তাব করেছিলেন যে নিউটনের মাথায় একটি আপেল পড়ে যাওয়া এবং পিথাগোরাসের উপপাদ্য "ভুয়া খবর" - এটির বেশিরভাগই পৌরাণিক অতীতে আমাদের পণ্ডিতদের কাছে পরিচিত ছিল, অর্থাৎ। হিন্দুরা প্রথমে সেখানে পৌঁছেছিল। তিনি ছঁড়ৎধ-তে এই তথ্যটি পেয়েছেন, তাই স্বাভাবিকভাবেই এটি অবশ্যই ১০০% সত্য। রাজ্য সরকার এখন কেন্দ্রের কাছে এই লাইনগুলিতে একটি অবস্থানের কাগজপত্র জমা দিয়েছে।
ইতিমধ্যে, লোকসভা সচিবালয় `বিশ্বাসঘাতক`, `অযোগ্য,` `দুর্নীতিগ্রস্ত` এবং `ভণ্ডামি`-এর মতো শব্দগুলিকে সংসদীয় হিসাবে নিষিদ্ধ করেছে। আরও মর্মান্তিক যেটি তা হল যে অনেক লোক এটি বিশ্বাস করে এবং একমত। হোয়াটসঅ্যাপ ডিগ্রিধারীরা শান্তভাবে বলবেন যে তারা একটি ফরোয়ার্ড পেয়েছেন যা প্রমাণ করে যে এই `ঐতিহাসিক দাবিগুলি` সত্য। বৈদিক যুগের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আজকাল বেশ জনপ্রিয়।
সরকার বা দলীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা বিবৃত বা সমর্থন করা বানালিটির ব্যারেজ আরও অনেক বেশি পিছিয়ে যায় - ২০১৪ এর চেয়ে কম নয় যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিজ্ঞানী এবং ডাক্তারদের একটি সমাবেশে বলেছিলেন যে গণেশ এবং কর্ণের জন্মে হাতির মাথা প্রমাণ করে যে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কসমেটিক সার্জারি বহু শতাব্দী আগে ভারতে করা হয়েছিল। বিজেপি সাংসদ সত্যপাল সিং, মুম্বাইয়ের একজন প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার, ডারউইনের তত্ত্বগুলিকে খারিজ করে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে তিনি বনমানুষের সন্তান নন। রোগের চিকিৎসার জন্য প্রস্রাবের থেরাপির শ্রেষ্ঠত্ব অবশ্যই সংঘ পরিবারের জন্য বহুবর্ষজীবী বিষয়। আর মধ্যপ্রদেশের এক বিজেপি মন্ত্রী এই বছরের শুরুতে বলেছিলেন যে নরেন্দ্র মোদি হলেন ভগবান রামের অবতার।
ইডিওটিক, কেউ বলতে পারে এবং তাদের দেখে হাসতে পারে। এসব দাবি নিয়ে এক হাজার মেম তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এসব বক্তব্যের অনেকগুলোই নীতিতে পরিণত হয়। এবং যা হাস্যকর শোনায় তা শীঘ্রই অশুভ হয়ে ওঠে। মধ্যপ্রদেশের এক বিজেপি মন্ত্রীর ছেলের অভিযোগের ভিত্তিতে স্ট্যান্ডআপ কমিক মুনাওয়ার ফারুকীকে এমন একটি কৌতুক করার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল যা তিনি ক্র্যাক করেননি। এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে অব্যাহত সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের দুঃখজনক পরিণতি হয়, কখনও কখনও সম্প্রদায়ের বাইরেও। এবং অর্থনৈতিক বয়কটের আহ্বানের সাথে `গুজরাটের পুনরাবৃত্তি` করার হুমকি রয়েছে।
১৯৩০-এর দশকে, আমেরিকান লেখক ক্লারা লিজার রাজনৈতিক বন্দীদের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলার জন্য বেশ কয়েকবার জার্মানি সফর করেছিলেন। সেই আলোচনার উপর ভিত্তি করে নিবন্ধগুলির পাশাপাশি, তিনি একটি বইও প্রকাশ করেছিলেন, লুনাসি বিকমস আস, সাংবাদিক সহ নাৎসি নেতা, অনুসারী এবং সমর্থকদের মূর্খ এবং বোকা বক্তব্যের একটি সংকলন।
বইটি একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু হয় যা আমরা পরিচিত পেতে পারি - `দ্য গ্রেস অফ গড আমাদের ফুহরারে অংশগ্রহণ করে`, জুলিয়াস স্ট্রেইচার, রাইখস্ট্যাগের সদস্য এবং একটি ইহুদি-বিরোধী সংবাদপত্রের প্রকাশক। অভ্যন্তরে, মাস্টার রেস তৈরি করার জন্য মহিলাদের কর্তব্য সম্পর্কিত বিষয়গুলিতে কিছু রত্ন রয়েছে। `শুদ্ধতম স্টকের এক হাজার জার্মান মেয়েকে রাউন্ড আপ করুন। তাদের একটি শিবিরে বিচ্ছিন্ন করুন। তারপর তাদের সাথে যোগ দেওয়া হোক একশত জার্মান পুরুষের সমান বিশুদ্ধ স্টকের। যদি এই ধরনের একশটি শিবির স্থাপন করা হয়, তবে আপনার এক স্ট্রোকে এক লাখ শুদ্ধ জাত শিশু থাকবে, "ডাঃ উইলিবাল্ড হেনশেল পরামর্শ দেন। `যীশু পিতামাতার উভয় পক্ষেরই আর্য ছিলেন,` একটি পুস্তিকা বলে। কুখ্যাত ডঃ গোয়েবলস বলেছেন, `বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যকলাপ চরিত্র গঠনের জন্য একটি বিপদ।
আমরা এখন জানি, এই সব মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময়ের একটির দিকে পরিচালিত করেছিল। অ্যাডলফ হিটলারের ক্রমাগত দেবীকরণ এবং ইহুদি, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্যদের দানবীয়করণ, হলোকাস্টের দিকে পরিচালিত করেছিল। নাৎসিরা ইহুদিদের মতো করে ভারত মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ধারে কাছেও নেই, কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই তাদের বিরুদ্ধে একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রচারণা ঘটেছিল – তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া এবং ইহুদি বিরোধী আইন প্রণয়ন – নিশ্চিত করেছিল যে যখন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল এবং ক্ষুব্ধ হয়েছিল ভুক্তভোগীদের চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের ভিলেনে পরিণত করা হয়েছিল যাদের প্রতি কারও কোন সহানুভূতি ছিল না।
আজ ভারতে মুসলমানদের ‘দেশবিরোধী’ এবং ‘দেশদ্রোহী’ ধারণাটি বহুদূরে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু কট্টর সংঘের অনুসারীরাই নয়, যারা বছরের পর বছর ধরে মগজ ধোলাই করা হয়েছে, নব্য ধর্মান্তরিতরাও - শহুরে, শিক্ষিত এবং সুবিধাভোগীরা - এটি কিনেছে। তাদের সাম্প্রদায়িক চুলকানি আঁচড় দেওয়া হয়েছে এবং তারা তাদের আওয়াজ তুলতে যাচ্ছে না; তারা সঙ্ঘ পরিবারের মিথ্যা ঐতিহাসিক দাবীগুলোকে ঝেড়ে ফেলতে প্রস্তুত কারণ তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন কুসংস্কার, দীর্ঘদিনের লুকানো, এখন স্বাধীন মত প্রকাশ করা হচ্ছে।
যেকোনো গণতন্ত্রে ঘৃণা ও সন্দেহভাজন হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে; এখানে তাদের একটি বিনামূল্যে হাত দেওয়া হয় এবং এমনকি সংবর্ধিত করা হয়। এই দায়মুক্তি আকস্মিক নয়; তারা স্পষ্টভাবে সমর্থন করে কারণ তারা অকথ্য বলে, যদিও বেআইনি, জঘন্য হতে পারে। যোগী আদিত্যনাথ এই বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির থেকে অনেক বেশি এগিয়ে গেছেন কিন্তু এমন অনেক কিছু আছে যা তিনি বলতে বা করতে পারেন না – যেগুলো ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্টস’-এর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে, তারা অনেক দূরে চলে যায় এবং রাষ্ট্র এটি সহ্য করবে না দেখানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়, যখন ইয়াতি নরসিংহানন্দ গিরি মুসলমানদের গণহত্যার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অধিকাংশ অংশ জন্য এটি দূরে দেখায়.
সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বাগাড়ম্বর এবং সহিংসতার সাথে রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে যে আইন করে। একবার স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলি আইনি সমর্থন প্রদান করে, নতজানু মিডিয়া নিশ্চিত করে যে বৃহত্তর জনসাধারণ এই বার্তাটি পায় যে মুসলমানরা এক নম্বর শত্রু। হাস্যকর এবং মন্দের মধ্যে রেখাটি তখন খুব পাতলা হয়ে যায় এবং অবশেষে অদৃশ্য হয়ে যায়। এবং নাশকতাকারীরা তখন শত্রুতে পরিণত হয়।

মধ্যবিত্তের কান্নার শেষ কোথায়?
                                  

মোঃআরিফ উল্লাহ

করোনা ভাইরাস নামক এক অদৃশ্য দূর্যোগের থাবায় নাকাল মধ্যবিত্তের কপালে নতুন চিন্তার ভাজ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি। দুবেলা ভাত খাওয়াই যেন আজ দুরূহ হয়ে পড়েছে। কোভিড ১৯ এর কারণে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত অনেক পরিবার শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমিয়েছে কিন্তু তাতেও যেন রক্ষা মেলেনি, বর্তমানে দিনের পর দিন দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েই চলেছে, আজ তেলের দাম বাড়লো তো কাল ডালের দাম আর সেইসাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাসা ভাড়া, যাতায়াত খরচ ও ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ এর ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারের একবেলার খাবারের চাহিদা যোগানোর চিন্তাও বেড়ে যাচ্ছে, এক গবেষণায় দেখা যায় কোভিড ১৯ এর কারণে আয় কমে যাওয়ায় ৫২ শতাংশ মানুষ তাদের খাবার কমিয়ে দিয়েছে। পরিবারের কর্তাদের হতাশার বার্তা আর মনের সুপ্ত আর্তনাদ যেন কোনো ভাবেই আমাদের সরকারের কর্মকর্তাদের নিকট পৌছাতে পাড়ছে না।

একটি পণ্যের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে অন্য পণ্যের দাম না বাড়ালে যেন চলেই না, হোক সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির পণ্য। বলছি গ‍্যাস ও পানির কথা। কিছু দিন আগে ১৩ লিটার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ছিল ৯৫০ টাকার যা বেড়ে এখন ১৬০০ টাকা অন্যদিকে পানির দাম ২০ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য সুপারিশ করছে ওয়াসা। একটু অদ্ভুত মনে হলেও সত্য যে গত ১৩ বছরে ১৬ বার পানির দাম বৃদ্ধি করেছে আমাদের ওয়াসা। দাম বৃদ্ধির পরপর ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) তাদের ভ্রাম্যমাণ পন্য বিক্রয় সেবা চালু করে থাকে যা দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্তের একমাত্র ভরসা। আর তাই এই পরিবারের মানুষগুলী ট্রাক আসার আধাবেলা আগে থেকে অপেক্ষমাণ থাকে কারণ দিন শেষে যে আবার কাজে যেতে হবে নাহয় কাল চুলায় আগুণ জলবে না।

আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার একতৃতীয়াংশ মানুষকে মধ্যবিত্ত অবস্থানে দেখতে চাই, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সূত্র থেকে জানা গেছে বর্তমানে মোট জনসনংখ্যার ২০ শতাংশ মধ্যবিত্ত কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে ১ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ অতি দরিদ্র আর মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ দারিদ্র মানুষ রয়েছে। আমাদের স্বপ্নের সাথে বর্তমান পরিস্থিতির তফাৎ অনেক কিন্তু আমরা বাঙ্গালী তাই আমরা অসাধ্যকে সাধ্যের কাতারে নিয়ে আসতে পারি, যেমন পেরেছি ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাকে নিজের করেনিতে তেমনি পেরেছি পদ্মা সেতুর মত বড় প্রকল্পকে সফল করতে। সকলের মনে আজ একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিশেষ করে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের মাঝে, তা হলো “স্বাধীন হয়েও কিছু অসাধু মানুষের কাছে আমরা আজও কেনো পরাধীন?”

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এটাও বলছে আমাদের মাথাপিছু আয় ৩২৭ ডলার বেড়ে ২ হাজার ৫৫৪ ডলার হয়েছে যা ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ছিল ২ হাজার ২২৭ ডলার। তবে কি তৈলাক্ত মাথায় তৈল পড়ছে আর মধ্যবিত্ত দরিদ্র হচ্ছে, দরিদ্র পথের ভিখারি হচ্ছে? উন্নয়ন আমরা সকলেই চাই আর এই উন্নয়ন হতে হবে সমতার ভিত্তিতে। অন্যথায় জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন কিছু অসাধু স্বার্থলোভী ব্যবসায়ীর কাছে এভাবে জিম্মি হয়ে থাকবে, এর সাথে লাখো শহিদের আত্নদানে অর্জিত মহান স্বাধীনতা জাতীর কল্যাণের বিপরিতে কিছু অসাধু স্বার্থলোভী কারবারির স্বার্থ হাসিলে ব্যবহার হবে যা কখনো হতে দেয়া যাবে না। স্বাধীনতা সমতা ও ন্যায্যতার কথা বলে, কেউ খাবার অপচয় করবে আর কেউ ৩বেলা না খেয়ে থাকবে, ধনী আরো ধনী হবে আর গরীব আরো গরীব হবে এমন নীতি কেবল স্বাধীনতা বিরোধীরাই অনুসরণ করতে পারে।


দেশের উন্নয়নের সাথে কোনো ভাবেই যেন পাল্লা দিয়ে চলতে পাড়ছে না আমাদের দেশের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত নামক এই বিশাল শ্রেণী, আত্নসম্মানের ভয়ে সকল কষ্ট মুখ বুঝে সয্য করে যাওয়া এই মানুষগুলী তখনি নিজের কষ্টের কথা প্রকাশ করে যখন তারা নিতান্তই অপারগ। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সাথে দেশের নাগরিকের চাহিদার বিষয়কেও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখার দায়িত্ব সরকারের। তাই দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যে ভর্তুকির ব্যবস্থা ও কঠোর তদারকির মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল রাখা। অসাধু ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। সামনে রমজানকে পুঁজি করে দ্রব্যমূল্যের দাম যেন বৃদ্ধি করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া, যাতে করে ২০৩০ সালে আমরা আমাদের নির্ধারিত স্বপ্ন পূরণে ও এসডিজি অর্জনে ব্যর্থ না হই।


লেখকঃ মোঃ আরিফ ঊল্লাহ
উন্নয়ন কর্মী,
ইমেইলঃ [email protected]

চীন বিশ্বের কাঠগোড়ায়: উইঘুরদের বলপূর্বক বন্ধাকরনের ফলে জন্মহারে হ্রাস
                                  

মোঃ মজিবর রহমান শেখ

উইঘুর জনগণের বিরুদ্ধে চীনের অধিকার লঙ্ঘনের মূল্যায়নের জন্য লন্ডনে যে জনগণের ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়েছে, চীন হয়তো তাকে নিন্দা করেছে, কিন্তু এখন তুর্কি মুসলমানদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জঘন্য ঘটনা সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্থার দ্বারা আরো প্রমাণ পাওয়া গেছে। ‌ চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে বসবাসকারী, অস্ট্রেলিয়ান স্ট্রাটেজি পলিসি ইনস্টিটিউট, একটি অস্ট্রেলিয়ান থিংক-ট্রেংক, একটি বিশ্লেষণে উপসংহারে পৌঁছেছে যে জিনজিয়াং সুদুর পশ্চিম চীনে, সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিশ্বের সমস্ত অঞ্চলের মধ্যে ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছে।

জন্মহারের তীব্রতম পতন, ফলাফলগুলি অন্যান্য গবেষকদের রিপোর্ট কে সমর্থন করে যে চীন উইঘুর জনগণের বিরুদ্ধে কঠোর জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউটের রিপোর্ট দেখায় যে উইঘুর, কাজাখ এবং অন্যান্য মুসলিম জাতিগত সংখ্যালঘুদের ঘনত্ব সহ এলাকার জন্মহার ৪৮.৭৪ শতাংশ কমেছে।২০১৭ এবং ২০১৮ এর মধ্যে, এই দুই বছরের প্রথম টিতে, সংখ্যালঘু কাউন্টিতে জন্মহার ৪৩.৭ শতাংশ কমেছে, যেখানে ১ লক্ষ ৬০ হাজার কম শিশুর জন্ম হয়েছে। এটা হাস্যকর ভাবে চীনের হান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার কাউন্টিতে জন্মের সামান্য বৃদ্ধির সাথে তুলনা করে।

আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এপি ২০২১ সালের মে মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সহ-লেখক নাথান রুসার কে উদ্বৃত্ত করেছে, জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী উর্বরতার পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা শুরু করার পর থেকে ৭১ বছরের জন্মহার এই এতটা চরম পতন হয়েছে যা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় অভিজ্ঞ পতন এবং রুয়ান্ডা এবং কম্বোডিয়ার গণহত্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। ফলাফলগুলি ২০২০ সালে জার্মান গবেষকদের একটি প্রতিবেদন কে সমর্থন করে যা পাওয়া গেছে যে চীনা সরকার পদ্ধতিগতভাবে উইঘুর জন্মের হার কমিয়েছে জীবাণুমুক্তকরণ, গর্ভপাত এবং অন্তঃসত্ত্বা ডিভাইস ব্যবহার করে এবং তিন বা ততোধিক শিশু আছে এমন ব্যক্তিদের জরিমানা ও আটক করে। এপি নিশ্চিত করেছে যে অস্ট্রেলিয়ান প্রতিবেদনের অনেক পরিসংখ্যান চীনা সরকারি পরিসংখ্যান এর ভিত্তিতে ছিল।

এপি রিপোর্ট অনুসারে ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে জিনজিয়াংয়ের উচ্চপদস্থ অধিকারীরা অবৈধ জন্মের কার্যকর নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ করে দক্ষিণ জিনজিয়াংয়ে যেখানে বেশিরভাগ উইঘুর বাস করে। চীন প্রায় চার বছর আগে উইঘুরদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন শুরু করেছিল স্পষ্টতই বৃদ্ধি রোধ করতে। জিনজিয়াং অঞ্চলে একটি বিচ্ছিন্ন বাদী আন্দোলন, জোরপূর্বক আত্তীকরণের একটি নৃশংস প্রচারণা চালায়, এক মিলিয়নেরও বেশি লোককে সদ্য নির্মিত ক্যাম্প এবং কারাগারের নেটওয়ার্কে ফেলে দেয়। তবে ক্র্যাক ডাউনের আসল কারণ হতে পারে কৌশলগত চীনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশ্লেষক রা বলেছেন যে পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর যা উইঘুর স্বায়ও শাসিত অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে যায় এবং পূর্ব তুর্কিস্তানের একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবিকে কুঁকড়ে ফেলেছেন। উইঘুর রা জিনজিয়াংয়ে হান আধিপত্যের চিনা প্রচেষ্টা এবং জনগণের সংস্কৃতিকে আত্তীকরণ এর প্রতি অসন্তুষ্ট। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ অঞ্চলের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ হান চীনা যারা সবচেয়ে ভালো চাকরি ও ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করে।

উইঘুর জনগণের বিরুদ্ধে চীনের অধিকারের অপব্যবহার গনহত্যার সমান কিনা তা মূল্যায়ন করার জন্য লন্ডনে পিপলস ট্রাইবুনাল এর শুনানির জন্য একটি বিশাল বিব্রতকর অবস্থায় এসেছে। ২০২০ সালের জুন মাসে বিশ্ব উইঘুর কংগ্রেস,কাজাখ এবং অন্যান্য তুর্কি মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে "চলমান নৃশংসতা এবং সম্ভাব্য গণহত্যা" তদন্ত করার জন্য একটি স্বাধীন জনগণের ট্রাইবুনাল প্রতিষ্ঠা করার জন্য ব্রিটিশ ব্যারিস্টার সার জিওক্রে নাইস কিউসিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করেছিল। ট্রাইবুনালটি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে চালু করা হয়েছিল। যদি চীনের গণপ্রজাতন্ত্রীকে আন্তর্জাতিক আদালতের সামনে আনা সম্ভব হত তবে জনগণের ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হতো না। তবে চীন জেনেভা কনভেনশনের অনুসমর্থন কারী হলেও হেগভিত্তিক আদালতের এখতিয়ার সম্পর্কে চীনের সংরক্ষণের মতো কোনো সম্ভাবনা ছিল না। ‌

উইগুর ট্রাইবুনাল ওয়েবসাইট বলে, "ট্রাইব্যুনালের সামনে সমস্যাগুলি মোকাবেলা করতে পারে এমন অন্য কোন আদালতে যাওয়ার কোন পরিচিত পথ নেই"। পিআরসি উইঘুর, কাজাখ এবং অন্যান্য তুর্কি মুসলিম জনসংখ্যা কে বন্দী শিবিরে আটকে রেখেছে, তাদের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে ধর্ষণ এবং অন্যান্য যৌন সহিংসতা, দাসত্ব, জোরপূর্বক বন্ধাকরন, জোরপূর্বক নির্বাসন, জোরপূর্বক অঙ্গ সংগ্রহ এবং উইঘুর পরিবার গুলোতে হান চাইনিজ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

লন্ডন ট্রাইব্যুনালের সামনে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত বন্দিশিবির গুলি বলেছে যে তাদের যৌবনে বন্দিরা বন্দিদশায় নিখোঁজ হয়েছিল এবং ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি তে চীনের কালো বাজার বাণিজ্যের সেবা করার জন্য তাদের অঙ্গ অপসারণের পরে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কোষ, অজানা ওষুধ দেওয়া এবং কঠোর শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে। একজন মহিলা এপি কে বলেছেন যে সাড়ে ছয় মাসের গর্ভবতী অবস্থায় তাকে গর্ভপাত করতে বাধ্য করা হয়েছিল। উইঘুর ট্রাইব্যুনালের অনুমোদনের ক্ষমতা নেই, তবে যদি পিআরসি র বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলি প্রতিষ্ঠিত হয় তবে তা হবে গণহত্যার পরিমাণ এবং রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা গুলি চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।

ট্রাইবুনালের দুটি অধিবেশন নির্ধারিত হয়েছে; প্রথম অধিবেশন ৪ জুন থেকে ৭ জুন ২০২১ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয় অধিবেশনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত। ট্রাইব্যুনালের কোন গুরুত্ব না দেওয়ার ভান করার সময়, চীন প্রথম অধিবেশনের কার্যক্রমকে গুরুত্বের সাথে চিহ্নিত করে এবং ৯ জুন একটি অফিসিয়াল সংবাদ সম্মেলনে লন্ডনে সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত হওয়া কয়েকজন আত্মীয়কে হাজির করে যাতে পরবর্তী দের দ্বারা অভিযোগ গুলিকে মিথ্যা বলে নিন্দা করা যায় । উইঘুরদের সাথে অমানবিক আচরণ ইতিমধ্যে চীনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের আকর্ষণ শুরু করেছে, চীনের কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার দ্বারা সমন্বিত প্রচেষ্টায় ১৯৮৯ সালে তিয়ানানমেন স্কয়ার গণহত্যার পর এই প্রথম ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনের উপর মানবাধিকার ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।

এপ্রিল মাসে, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস এবং কানাডার আইনসভা অনুসরণ করে উইঘুরদের বিরুদ্ধে বেইজিংয়ের নীতিকে গণহত্যা এবং অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে। প্রাক্তন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পাম্পে ও অফিসে বসার আগেই ঘোষণা করেছিলেন যে জিনজিয়াং মুসলিম এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে চীনের নীতি মানবতা এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে অপরাধ। তার উত্তরাধিকারী এন্টনি ব্লিক্ঙেন অফিসে প্রথম দিনে একই দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন। ‌

ব্লিক্ঙেন বলেছেন, "যুক্তরাষ্ট্র গ্লোবাল ম্যাগনিটসকী নিষেধাজ্ঞা কর্মসূচির মাধ্যমে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টায় একটি শক্তিশালী নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা অবিলম্বে PRC এর অপরাধ শেষ করার আহ্বান জানিয়ে বিশ্বজুড়ে আমাদের মিত্রদের পাশে দাঁড়াতে থাকব। গ্লোবাল ম্যাগনিটসকি হিউম্যান রাইটস একাউন্টেবিলিটি এ্যাক্ট ২০১৬ সালে মার্কিন কংগ্রেস দ্বারা প্রণীত হয়েছিল, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত বিশ্বের যে কোন বিদেশী সরকারি কর্মকর্তাদের অনুমোদন করার অনুমতি দেয়।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং কানাডা ২০২১ সালের মার্চ মাসে একটি যৌথ বিবৃতিতে বলেছিল,: চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে একটি স্পটলাইট উজ্জ্বল করতে আমরা একসাথে দাঁড়াতে থাকবো। আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছি এবং জিনজিয়াংয়ে যারা ভুক্তভোগী তাদের জন্য ন্যায় বিচারের আহ্বান জানাই।

লেখক : মোঃ মজিবর রহমান শেখ
০১৭১৭৫৯০৪৪৪

`ডা. মুরাদ আপনি দোষী থাকবেন দুনিয়া ও আখেরাতে`
                                  

অনলাইন ডেস্ক : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের সঙ্গে ঢালিউডের চিত্রনায়ক ইমন ও নায়িকা মাহিয়া মাহির মধ্যকার কথোপকথনের একটি অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে। বিষয়টিকে নারীর প্রতি অবমাননাকর বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট তারানা হালিম।

সোমবার রাতে তিনি নিজের ফেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে মুরাদ হাসানকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে একথা বলেন। পোস্টে তারানা হালিম লিখেছেন, ‘ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

তথ্য প্রতিমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও লিখেছেন, মুরাদ হাসান আপনি কর্মক্ষেত্রে যা করেছেন তা conflict of interest। আপনি যে ভাষায় কথা বলেছেন তা বিকৃত রুচির, অশালীন, নারীর প্রতি অবমাননাকর। আপনি দলের ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষু্ণ্ণ করেছেন। শাস্তি আপনার প্রাপ্য।

সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী বলেন, রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন- ভালো মানুষ নারীকে সম্মান করে। তাই আপনি দোষী থাকবেন দুনিয়াতে ও আখেরাতে। আমরা যারা দলকে ভালোবাসি তারা জানি এই সিদ্ধান্ত নেবার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে কঠিন , কঠোর হতে হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছ থেকে এটাই আশা করি আমরা।

সরকারপ্রধানের প্রতি নিজের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে তারানা হালিম বলেন, ভবিষ্যতে সব লুটেরা, ঘুষখোর, লম্পটের বিরুদ্ধে আপনার এমন কঠোর পদক্ষেপ অব্যাহত থাকুক। এই দৃষ্টান্ত যেন সবার জন্য শিক্ষার কারণ হয়।

বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ‘বঙ্গমাতা’
                                  

‘সারা জীবন তুমি সংগ্রাম করেছ, তুমি জেল জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছ, তুমি জানো যে এ দেশের মানুষের জন্য কী চাই, তোমার থেকে বেশি কেউ জানে না, তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি শুধু সেই কথাই বলবে, কারো কথা শুনতে হবে না। তুমি নিজেই জানো তোমাকে কী বলতে হবে। তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি সে কথাই বলবা।’

যে মহীয়সী নারীর এমন দৃঢ়প্রত্যয় সাহস জোগানোর ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন ৭ই মার্চের অমর ভাষণ দিয়েছিলেন, বাঙালি জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন, ৭ই মার্চের ভাষণের নেপথ্য শক্তি—তিনি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ডাকনাম রেণু। ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা শেখ জহুরুল হক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের জ্ঞাতি সম্পর্কের চাচা এবং গ্রামের বর্ধিষ্ণু কৃষক পরিবার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, ‘একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বারো-তেরো বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন যে আমার সাথে তার এক নাতনির বিবাহ দিতে হবে। কারণ তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাবেন। রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধ হয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা হোসনে আরা বেগম মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। রেণুর সাত বছর বয়সে দাদাও মারা যান। তারপর সে আমার মায়ের কাছে চলে আসে। রেণুদের ঘর আমার ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান।’

শেখ মুজিবের মা বেগম সায়রা খাতুন পাঁচ বছর বয়সে মাতৃহীন রেণুকে ঘরে তুলে নেন এবং নিজের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে শিক্ষাদীক্ষা ও গৃহকর্মে বড় করে তোলেন। শৈশব থেকেই রেণু শেখ মুজিবসহ পরিবারের ছোট-বড় সব সদস্যের কাছে নিজেকে আপন হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। বিশেষ করে বড় সন্তান খোকা (শেখ মুজিবের ছোটবেলার ডাকনাম), যাঁর সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক, তাঁর চলাফেরা, কিশোর বয়স থেকেই নানা কর্মকাণ্ড, খানিকটা দুরন্তপনা, বেপরোয়া ও সাহসী মনোভঙ্গি কিশোরী ফজিলাতুন্নেছা রেণুর জন্যও বড় হওয়ার প্রেরণা ও মুগ্ধতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের যেকোনো বিপর্যয়ে, অসুখ-বিসুখে উদ্ধারকর্মী হিসেবে শেখ মুজিবের সঙ্গে নিজেও তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ান।

মহীয়সী এই নারী প্রেমময়ী স্ত্রী, স্বার্থ বিসর্জক, ত্যাগী নারী ও আদর্শ মাতা যেমন ছিলেন, অন্যদিকে নিজেকে একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলেন। চিন্তাচেতনা ও আদর্শের সমান অংশীদারি অর্জনে সমর্থ হন। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গী বহুমাত্রিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এই নারী মানুষের ভালোবাসা অর্জন করে হয়ে ওঠেন বঙ্গমাতা।

প্রাথমিক জীবনে নিজের লেখাপড়া বেশি দূর না এগোলেও স্বামীর শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর নজর ছিল অতন্দ্র।
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন “কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। লেখাপড়া তো মোটেই করি না। ভাবলাম কিছুদিন লেখাপড়া করব। মাহিনা বাকি পড়েছিল, টাকা-পয়সার অভাবে। রেণুর কাছে আমার অবস্থা প্রথমে জানালাম। আব্বাকে বললে তিনি অসন্তুষ্ট হলেন মনে হলো। কিছুই বললেন না। টাকা দিয়ে আব্বা বললেন, ‘কোনো কিছুই শুনতে চাই না। বিএ পাস ভালোভাবে করতে হবে। অনেক সময় নষ্ট করেছ, ‘পাকিস্তানের আন্দোলন’ বলে কিছুই বলি নাই। এখন কিছুদিন লেখাপড়া কর।’ আব্বা-মা, ভাই-বোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্রুজল’ বোধ হয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, ‘একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এসো।’” প্রয়োজনে নিজের জমির ধান বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি নিয়মিত স্বামীকে সহযোগিতা করে গেছেন। স্বামীর পাশে থেকে মানবতার জন্য কাজ করে গেছেন। জীবনে ঝুঁকি নিয়েছেন বহুবার। আড়াল থেকেই তিনি বাংলার মানুষের সেবা করে গেছেন আজীবন।

বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম পাতা শুরু করেছিলেন সঙ্গী সহধর্মিণীর কথা দিয়ে। কেননা বেগম মুজিবের তাগিদেই এই প্রজন্মের বাঙালি আজ হাতে পেয়েছে স্বাধিকার আন্দোলনের এক অমূল্য দলিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের কাহিনি রচনার পেছনে স্ত্রীর যে উদ্যোগ ও উৎসাহ পেয়েছেন তাঁর বর্ণনায় লিখেছেন—
“আমার স্ত্রী আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেল গেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরো একদিন জেল গেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। ‘বসেই তো আছ, লেখো তোমার জীবনের কাহিনি।’ বললাম, লিখতে যে পারি না; আর এমন কী করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।”

সেই ছোট্টবেলা থেকে এবং পরবর্তীকালে স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের এক আত্মত্যাগী সহযোগী হয়ে ওঠেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সংগ্রাম, আন্দোলন ও কারাজীবনেও তিনি এক অনুকরণীয় ত্যাগী নারী হিসেবে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। স্ত্রী হিসেবে তাঁর জীবনকালে কখনো স্বামীকে একনাগাড়ে দুই বছর কাছে পাননি। কিন্তু কোনো দিন কোনো অনুযোগ-অভিযোগ ছিল না, কখনো বলেননি যে তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও, চলে আসো বা সংসার করো বা সংসারের খরচ দাও। জীবনে কোনো প্রয়োজনে কোনো দিন বিরক্ত হননি। যত কষ্টই হোক কখনো ভেঙে পড়তে দেখা যায়নি তাঁকে।

একদিকে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার সামলানো, আবার কারাগারে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করে তাঁর মনোবল দৃঢ় রাখা; অন্যদিকে আইনজীবীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মামলার খোঁজখবর নেওয়া। নিজের সোনার অলংকার বিক্রি করেও মামলার খরচ জুগিয়েছেন। নিজেকে বঞ্চিত করে তিনি স্বামীর আদর্শ ও সংগঠনের জন্য নিজের সম্বল প্রায় সবই বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর স্বামী দেশের জন্য কাজ করছেন, মানুষের কল্যাণের জন্য করছেন। টাকার অভাব, সংসার চালাতে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতাদের সাহায্য দরকার, কেউ অসুস্থ তাকে টাকা দিতে হচ্ছে। কিন্তু কখনোই এসব কথা কাউকে বলতেন না। নীরবে কষ্ট করে সমস্যার সমাধান করেছেন।

এমনও দিন গেছে মামলা চালাতে গিয়ে তাঁর কাগজপত্র, উকিল জোগাড় করতে অনেক খরচ হয়ে গেছে। এদিকে বাজারও করতে পারেননি। কোনো দিন বলেননি যে টাকা নাই, বাজার করতে পারলাম না। চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করেছেন। আচার দিয়ে ছেলে-মেয়েদের বলেছেন যে প্রতিদিন ভাত-মাছ খেতে ভালো লাগে নাকি। আসো, আজকে আমরা গরিব খিচুড়ি খাই, এটা খেতে খুব মজা। একজন মানুষ, তাঁর চরিত্র কতটা সুদৃঢ় থাকলে যেকোনো অবস্থা মোকাবেলা করার মতো ক্ষমতা ধারণ করতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে পদে পদে তিনি আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। প্রকাশ্যে প্রচারে কখনোই আসেননি।

১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু প্রথম তিন মাসে আটবার গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তান সরকার ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে আবার গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করে। ৭ জুন ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে ধর্মঘট সফলভাবে পালনে বেগম মুজিবের ভূমিকা ছিল অন্যতম। গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি লুকিয়ে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে তাঁদের ছোট ফুফুর ফ্ল্যাট বাসায় চলে যেতেন। ওখানে গিয়ে নিজের স্যান্ডেল বদলাতেন, কাপড় বদলে, বোরকা পরে একটা স্কুটার ভাড়া করে ঢাকায় পড়ুয়া ছোট ভাইকে নিয়ে ছাত্রনেতা আর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতেন। আন্দোলন চালাবে কিভাবে তার পরামর্শ, নির্দেশনা তিনি নিজেই দিতেন। আবার ওই বাসায় ফিরে এসে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে নিজের বাসায় ফিরতেন। বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে এই ধর্মঘট যাতে পালিত হয় এবং চলমান আন্দোলনের সফলতার জন্য তিনি নিরলস কাজ করে যেতেন। সবই করতেন গোপনে এবং রাজনৈতিক মেধায়।

একটা সময় এলো ছয় দফা, না আট দফা? পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নেতারা চলে এলেন ঢাকায়। তদানীন্তন শাহবাগ হোটেলে থাকতেন নেতারা। বেগম মুজিব মাঝে মাঝে বড় মেয়ে হাসুকে (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শেখ হাসিনা) পাঠাতেন তাঁদের স্ত্রীদের একটু খোঁজখবর নিয়ে আসার জন্য, আর সেই সঙ্গে কে কে আছে একটু দেখে এসে তাঁকে জানাতে। ছোট ভাই রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে রুমে রুমে গিয়ে সব দেখেশুনে মাকে এসে রিপোর্ট দিতেন শেখ হাসিনা। বেগম মুজিবের একটা ভালো নেটওয়ার্ক ছিল সারা দেশে। কোথায় কী হচ্ছে তার সব খবর চলে আসত তাঁর কাছে। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন তিনি। রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক নেতাই বেগম মুজিবের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন।

আওয়ামী লীগের মধ্যে সে সময় খুব গোলমাল। একদল পিডিএমএ যোগদান করার পক্ষে, আর একদল ছয় দফা। ১৯ মে ১৯৬৬ সালে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়িতে ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা। ডেকোরেটর, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সে যুগে ছিল না, নিজ হাতে রান্না করে তিন দিন সবাইকে খাইয়েছেন বেগম মুজিব। সঙ্গে বিভক্ত নেতাদের নানা পরামর্শ দিয়েছেন, সাবধান করেছেন যেন ছয় দফা থেকে আট দফার দিকে চলে না যায়। বেগম মুজিবের মানসিক দৃঢ়তা সেই সময়ের রাজনৈতিক জাতীয় সংকট উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত কার্যকর ছিল।

নেতাদের নানামুখী পরামর্শে তিনি শুধু বলতেন, ‘লেখাপড়া জানি না কী বুঝব, খালি এটুকু বুঝি যে ছয় দফা আমাদের মুক্তির সনদ, এর বাইরে আমি কিছু জানি না।’ জেলখানা থেকে শেখ মুজিব দৃঢ় উচ্চারণে জানিয়ে দিয়েছেন, আর যাই হোক ছয় দফা থাকতেই হবে। ছয় দফা থেকে একচুল এদিক-ওদিক হওয়া যাবে না। বিশেষ কাউন্সিলের সভায় সিদ্ধান্ত হলো ছয় দফা ছাড়া আর কিছু হবে না।

বেগম মুজিবের স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। একবার যা শুনতেন তা আর ভুলতেন না। স্লোগান থেকে শুরু করে অনেক রাজনৈতিক পরামর্শ, নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত আসত বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে।

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকাকালে প্রতিদিন কী বিপুল আগ্রহে স্ত্রীর আগমনের প্রতীক্ষায় থাকতেন তা তাঁর লেখনীতে দেখতে পাই। ঘরে-বাইরে বেগম মুজিবই ছিলেন তাঁর পরামর্শক, উপদেষ্টা, সহচর আর নির্ভরতার আশ্রয়স্থল। সে সময়ের লেখা কারাগারের রোজনামচা থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।

১৫ জুন ১৯৬৬
দুঃখ করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘মাত্র ২০ মিনিট সময় যাবতীয় আলাপ করতে হবে। কথা আরম্ভ করতেই ২০ মিনিট কেটে যায়। নিষ্ঠুর কর্মচারীরা বোঝে না যে স্ত্রীর সাথে দেখা হলে আর কিছু না হউক একটা চুমু দিতে অনেকেরই ইচ্ছা হয়, কিন্তু উপায় কী? আমরা তো পশ্চিমা সভ্যতায় মানুষ হই নাই। তারা তো চুমুটাকে দোষণীয় মনে করে না। স্ত্রীর সাথে স্বামীর অনেক কথা থাকে, কিন্তু বলার উপায় নাই।’

২৬ জুন ১৯৬৬
রেণু স্যারিডন খেতে দিতে চাইত না। ভীষণ আপত্তি করত। বলত, হার্ট দুর্বল হয়ে যাবে। বলতাম, আমার হার্ট নাই, অনেক পূর্বেই শেষ হয়ে গেছে। বাইরে তার কথা শুনি নাই কিন্তু জেলের ভিতর তার নিষেধ না শুনে পারলাম না।

৬ জুলাই ১৯৬৬
বিকালে চা খাবার সময় সিকিউরিটি জমাদার সাহেবকে আসতে দেখে ভাবলাম বোধ হয় বেগম সাহেবা এসেছেন। গত তারিখে আসতে পারেন নাই অসুস্থতার জন্য। ‘চলিয়ে, বেগম সাহেবা আয়া।’ আমি কি আর দেরি করি? তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবি পরেই হাঁটা দিলাম গেটের দিকে। রেণুকে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘খুব জ্বরে ভুগেছ। এখন কেমন আছ?’
‘পায়ে এখনো ব্যথা। তবে জ্বর এখন ভালোই।’
 বললাম, ‘ঠাণ্ডা লাগাইও না’।
আজ অনেক সময় কথা বললাম। সময় হয়ে গেছে, ‘যেতে দিতে হবে।’ বিদায় দিয়ে আমার স্থানে আমি ফিরে এলাম।
কখনো কখনো স্ত্রীর উপস্থিতি কামনায় আকুল হয়ে উঠতেন, অপেক্ষা করে থাকতেন, না এলে মুষড়ে পড়তেন কিছুক্ষণের জন্য—

২১ জুলাই ১৯৬৬
ভেবেছিলাম আজ রেণু ও ছেলে-মেয়েরা দেখতে আসবে আমাকে। হিসাবে পাওয়া যায় আর রেণুও গত তারিখে দেখা করার সময় বলেছিল, ‘২০ বা ২১ তারিখে আবার আসব।’ চারটা থেকে চেয়েছিলাম রাস্তার দিকে। মনে হতে ছিল এই বোধ হয় আসে খবর। যখন ৫টা বেজে গেল তখন ভাবলাম, না অনুমতি পায় নাই।

শেখ মুজিবের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেগম ফজিলাতুন্নেছা ছিলেন অফুরান প্রেরণার উত্স। ১৯৬৬-তে ছয় দফা ঘোষণার পর থেকে শেখ মুজিব যখন বারবার জেলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তখন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বেগম মুজিবের কাছে ছুটে আসতেন। তিনি তাঁদের বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন নির্দেশনা পৌঁছে দিতেন এবং লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগাতেন। জেলখানায় দেখা করার সময় ছেলে-মেয়েদের শিখিয়ে নিতেন একটু হৈচৈ করার জন্য, আর ওই ফাঁকে বাইরের সমস্ত রিপোর্ট স্বামীর কাছে দেওয়া আর তাঁর কাছ থেকে পরবর্তী করণীয় নির্দেশনা জেনে নেওয়া। নির্দেশনাগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

১৭ মার্চ ১৯৬৭
আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনো দিন নিজে পালন করি নাই। বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। পাঁচটাও বেজে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার সাহেব বললেন, ‘চলুন, আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলে-মেয়েরা এসেছে।’ তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওয়ানা করলাম জেলগেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই বত্সরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা নিয়ে রাসেলকে পরাইয়া দিলাম। ছেলে-মেয়েদের চুমা দিলাম। সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়াছে। রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেলগেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো।

ছয়টা বেজে গিয়াছে, তাড়াতাড়ি রেণুকে ও ছেলে-মেয়েদের বিদায় দিতে হলো। রেণুও বড় চাপা, মুখে কিছুই প্রকাশ করে না। ফিরে এলাম আমার অস্তানায়।

১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রথমে মুক্তি দিয়ে জনগণের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে জেলগেটেই সেনাবাহিনীর লোকজন পুনরায় গ্রেপ্তার করে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যায়। পাঁচ মাস তাঁর পরিবার জানতেও পারেনি তিনি কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন, বেঁচে আছেন কি না? পুরো পরিবার নিয়ে চরম উত্কণ্ঠা, উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায় কেটেছে বঙ্গমাতার। আগরতলা মামলায় সামরিক বাহিনীর ইন্টারোগেশনের সম্মুখীনও হতে হয়েছে একাধিকবার ।

দেশের অনেক, এমনকি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নেতারা বেগম মুজিবের কাছে আসতেন দেখা করতে, পরামর্শ নিতে, নির্দেশনা জানতে। আইয়ুব খান ভুট্টোকে মন্ত্রিত্ব থেকে বের করে দিলে সে-ও ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাসায় ছুটে আসে। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা এলে পর্দার আড়াল থেকে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতেন বেগম মুজিব। কখনোই সামনে আসতেন না। ছেলে-মেয়েদের বলতেন, ‘ওদের সাথে তো আর আমরা থাকব না, কেন দেখা করব? ওদের চেহারাও আমার দেখতে ইচ্ছা করে না।’ বঙ্গবন্ধু এমএনএ, এমপি-মন্ত্রী থাকাকালে অনেকবার করাচি গেছেন। বেগম মুজিব একবারের জন্যও তাঁর সঙ্গী হন নাই। কখনো যেতে চাইতেন না। সবার আগে তিনিই বুঝেছিলেন এ দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। তাঁর মধ্যে এই চেতনা অত্যন্ত তীব্র ছিল এবং বিশ্বাসও ছিল।

আগরতলা মামলা নিষ্পত্তির জন্য আইয়ুব খান লাহোরে গোলটেবিল বৈঠক ডাকে। প্রস্তাব দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে ছাড়া হবে প্যারোলে। বেগম মুজিব স্বামীর কাছে খবর পাঠালেন যেন তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত না নেন। জানালেন দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ আছে। মামলা তুলে বঙ্গবন্ধুসহ বন্দি ৩৫ জনের সবাইকে মুক্তি দিলেই গোলটেবিল বৈঠক হতে পারে, অন্যথা একা যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে যে দূরদর্শিতা তিনি সেদিন দেখিয়ে ছিলেন তা পরবর্তী সময়ে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের পথের নির্দেশনা দিয়েছিল।

নেপথ্যে থেকে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে এবং ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। বন্দি থেকেও পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ এড়িয়ে দলের নেতাদের নির্দেশনা পৌঁছে দিতেন। বেশ কয়েকবার গোয়েন্দা সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদ ও শাস্তি-নির্যাতনের হুমকি দেয়, তবু তিনি ছিলেন অকুতোভয়।

দেশের উত্তাল পরিস্থিতিতেও প্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছেন জাতির জনককে। পাঁচ সন্তানকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন এই মহীয়সী নারী। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ইতিহাসে শুধু একজন রাষ্ট্রনায়কের সহধর্মিণী নন, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের নেপথ্যের অন্যতম অনুপ্রেরণাদানকারী মহীয়সী নারী। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন তিনি। ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের সময়ও জীবনের মতো মরণের সহযাত্রী হলেন শেখ মুজিবের। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আজ সশরীরে বেঁচে না থাকলেও তিনি বেঁচে আছেন প্রত্যেক দেশপ্রেমিক বাঙালির হূদয়ে। তাঁর দেশপ্রেম ও আদর্শ অনুপ্রেরণার উত্স হয়ে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যাওয়া এক মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব একে অপরের সম্পূরক। বঙ্গবন্ধুর আপসহীন নেতৃত্ব ও বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের যে দুর্বারতা তার উেস ছিলেন বেগম মুজিব। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু; কিন্তু এই নেতৃত্বকে সহায়ক শক্তি, নির্যাতনবরণের ধৈর্য ও প্রেরণা জুুগিয়েছেন এই মহীয়সী সংগ্রামী নারী। মনেপ্রাণে একজন আদর্শ বাঙালি নারী ছিলেন বঙ্গমাতা। ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থেকেও সুখ-শান্তি তাঁর কাছে বড় হয়ে ওঠেনি। ত্যাগের মনোভাব নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণা ও শক্তি জুগিয়েছেন। রাজনৈতিক ও জাতীয় সংকট উত্তরণে দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম যেমন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে চিরকাল ইতিহাসের পাতায় অম্লান থাকবে, তেমনি বাঙালি জাতি চিরকাল স্মরণ করবে তাঁর প্রিয়তমা পত্নী ‘বঙ্গমাতা’ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে। আজ ৮ আগস্ট বঙ্গমাতার জন্মদিন। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

রিয়াজ আহমেদ , লেখক : অধ্যাপক


   Page 1 of 5
     মতামত
কলকাতা প্রেসক্লাবের নিবন্ধন ৬৮ বছর পেরিয়ে- ২
.............................................................................................
কলকাতা প্রেসক্লাবের ৬৮ বছর পেরিয়ে - ১
.............................................................................................
অল্টারনেটিভ (বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা)
.............................................................................................
প্রাথমিক শিক্ষায় উন্নয়নের ধারা
.............................................................................................
প্রত্যাশা: আত্মশুদ্ধির উদ্বোধন
.............................................................................................
গণহত্যার শিকারদের স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস
.............................................................................................
বিনোদনের নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকি
.............................................................................................
ভারত ও বাংলাদেশের উচিত তিস্তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করা
.............................................................................................
ভারত সীমান্তে বেআইনি হত্যাকাণ্ড: বিচার চাইছে বাংলাদেশি পরিবার
.............................................................................................
নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে কে?
.............................................................................................
বন্ধুত্বই গড়বে সম্প্রীতির বাংলাদেশ
.............................................................................................
বানালিটির কুফল এবং এর পরে যা হয়
.............................................................................................
মধ্যবিত্তের কান্নার শেষ কোথায়?
.............................................................................................
চীন বিশ্বের কাঠগোড়ায়: উইঘুরদের বলপূর্বক বন্ধাকরনের ফলে জন্মহারে হ্রাস
.............................................................................................
`ডা. মুরাদ আপনি দোষী থাকবেন দুনিয়া ও আখেরাতে`
.............................................................................................
বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ‘বঙ্গমাতা’
.............................................................................................
দেশে করোনার ২য় পর্যায়ের ধাক্কা আসতে পারে : ডা. বেনজির
.............................................................................................
মানুষের বিবেকবোধ কোথায়?
.............................................................................................
মার্কিন বিশেষজ্ঞের বার্তা, ১৯১৮ সালের ফ্লু`র মতোই মারণরূপ নিতে পারে করোনা
.............................................................................................
কোরবানির গরু অনলাইনে কিনবেন বাণিজ্যমন্ত্রী
.............................................................................................
এক মাসে চার বলিষ্ঠ নেতা হারাল আ.লীগ
.............................................................................................
টেস্ট কমায় বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
.............................................................................................
পুষ্টি সঠিকভাবে না পেলে ওষুধ আর হাসপাতাল দিয়ে কাজ হবে না
.............................................................................................
করোনা ভাইরাস: সরকারী ত্রাণ, প্রণোদনা ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন
.............................................................................................
প্রতিনিয়ত শক্তিশালী হচ্ছে করোনাভাইরাস: গবেষণা
.............................................................................................
করোনা সন্দেহ হলে কী করবেন, কোথায় যাবেন?
.............................................................................................
গর্ভবতী মায়েরা প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বের হবেন না
.............................................................................................
‘১৩ ঘণ্টায় ১০ মিনিট’ অলৌকিকভাবে বাঁচার বর্ণনা দিলেন সুমন
.............................................................................................
করোনার আরো তিনটি নতুন উপসর্গের সন্ধান পেয়েছে সিডিসি
.............................................................................................
নিজে সচেতন হোন, অন্যকেও সচেতন হতে বলুন : হানিফ সংকেত
.............................................................................................
মহামারী রোধে মহানবী (সা.) এর নির্দেশনা অত্যন্ত কার্যকর: মার্কিন গবেষক
.............................................................................................
করোনা প্রতিরোধে বিনামূল্যে মাস্ক দিতে হাইকোর্টে ব্যারিস্টার মওদুদের পরামর্শ
.............................................................................................
করোনা নিয়ে মোদির পরামর্শ
.............................................................................................
বিদেশিদের ঘরে থাকার পরামর্শ আইইডিসিআরের
.............................................................................................
ঢাকা প্রেসক্লাব দ্বি-বার্ষিক নির্বাচন ২০২০-২১ : সভাপতি- মোঃ মাসুদুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক- মোঃ মোসলেহ উদ্দিন বাচ্চু
.............................................................................................
আগামী সপ্তাহ থেকে অনলাইন পোর্টালের নিবন্ধন শুরু : তথ্যমন্ত্রী
.............................................................................................
সাংবাদিক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আর নেই
.............................................................................................
ক্র্যাবের সাবেক সভাপতি লাবলু আর নেই
.............................................................................................
দুদককে ক্ষমা চাইতে হবে, সাংবাদিকদের বিক্ষোভ
.............................................................................................
নবম সংবাদপত্র মজুরি বোর্ড নিয়ে নোয়াবের বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করেছে বিএফইউজে-ডিইউজে
.............................................................................................
ডিআরইউ`র দুই যুগ পূর্তি উপলক্ষে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত
.............................................................................................
৬৫ বারের মতো পেছালো সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন
.............................................................................................
বাসস`র সাবেক বিশেষ সংবাদদাতা মুজিবুল হকের ইন্তেকাল
.............................................................................................
নবম ওয়েজ বোর্ড কার্যকর ও গণমাধ্যম কর্মী আইন পাসের দাবি সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের
.............................................................................................
মাহফুজ উল্লাহর দ্বিতীয় জানাজা হবে জাতীয় প্রেসক্লাবে
.............................................................................................
পিআইবির নতুন চেয়ারম্যান আবেদ খান
.............................................................................................
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধন চেয়ে রাস্তায় সম্পাদকরা
.............................................................................................
গোলাম সারওয়ারের মরদেহ দেশে
.............................................................................................
গোলাম সারওয়ারের মরদেহ আসছে আজ, বৃহস্পতিবার দাফন
.............................................................................................
বদি মাদকের গডফাদার, প্রমাণ কী?
.............................................................................................

|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক : মো: তাজুল ইসলাম
প্রধান কার্যালয়: ২১৯ ফকিরের ফুল (১ম লেন, ৩য় তলা), মতিঝিল, ঢাকা- ১০০০ থেকে প্রকাশিত । ফোন: ০২-৭১৯৩৮৭৮ মোবাইল: ০১৮৩৪৮৯৮৫০৪, ০১৭২০০৯০৫১৪
Web: www.dailyasiabani.com ই-মেইল: [email protected]
   All Right Reserved By www.dailyasiabani.com Dynamic Scale BD