মিয়া আবদুল হান্নান : বিভিন্ন জনসভা ও বক্তব্যে তিনি প্রায়ই বলতেন— ব্যাটা তারেক রহমান বুকের পাটা “ক্ষমতা থাকলে তারেক রহমান দেশে এসে রাজনীতি করুক। শেখ হাসিনা তারেক রহমানকে বলেছিলো `সাহস থাকলে দেশে আয়`, জনগণ এখন শেখ হাসিনাকে একই কথা বলছে ভারতে কেন! দেশে এসে আইনের মোকাবিলা করতে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছু কিছু ঘটনা কেবল রাজনৈতিক নয়—তা ইতিহাস হয়ে ওঠে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ১৭ বছর পর দেশে প্রত্যাবর্তন তেমনই একটি ঘটনা। এটি শুধু একজন রাজনৈতিক নেতার দেশে ফেরা নয়; বরং এটি একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, নির্বাসন, প্রতিশোধপরায়ণ শাসন এবং অহংকারের রাজনীতির অবসানের প্রতীক।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে বলেছিলেন শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় রেখে দেশের কোনো সংকটেরই সমাধান সম্ভব নয়।
২০০৭ সালের ১১ মার্চ, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গ্রেফতার হন। পরে মুক্তি পেলেও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তিনি পরিবারসহ দেশের বাইরে যেতে বাধ্য হন। এরপর শুরু হয় দীর্ঘ নির্বাসিত জীবন—লন্ডনে অবস্থান, মামলা, সাজা, রাজনৈতিক চরিত্র হননের একের পর এক প্রচেষ্টা। ঐ সময়টাতে ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ, যার নেতৃত্বে শেখ হাসিনা টানা এক দশকেরও বেশি সময় রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রেখেছে।
এই দীর্ঘ সময়ে শেখ হাসিনার বক্তব্যে এক ধরনের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, বিদ্রুপ ও দম্ভের প্রকাশ বারবার দেখা গেছে। বিভিন্ন জনসভা ও বক্তব্যে তিনি প্রায়ই বলতেন—“ক্ষমতা থাকলে তারেক রহমান দেশে এসে রাজনীতি করুক।”এই বাক্যের মধ্যেই ছিল ক্ষমতার অহংকার, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যক্তিগত প্রতিশোধের হাতিয়ার বানানোর আত্মতুষ্টি।কিন্তু ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে—ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, দম্ভ আর অহংকার চিরস্থায়ী টিকে থাকে না। আল্লাহ তা’আলা জুলুম সহ্য করেন, কিন্তু অহংকার করেন না—এই বিশ্বাস শুধু ধর্মীয় নয়, ইতিহাসের বাস্তবতাও বটে। ফ্যাসিস আওয়ামী লীগের আমলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যেসব মামলা দায়ের করা হয়েছিল, সেগুলোর বেশিরভাগই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফসল—এমন অভিযোগ কেবল বিএনপির নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, আইনবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদেরও।
সূরা আল ইমরান : আল কুরআনের বাণী হে আল্লাহ! তুমি সমস্ত রাজ্যের অধিপতি, তুমি যাহাকে ইচ্ছা বাদশাহী প্রদান কর এবং তুমি যাহার নিকট হইতে ইচ্ছা কর বাদশাহী কাড়িয়া লও এবং যাহাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর এবং যাহাকে ইচ্ছা অপদস্থ কর, তোমার হাতেই সর্বমঙ্গল এবং নিশ্চয়ই তুমি সর্ববিষয়ের উপর সর্বশক্তিমান।
শেখ হাসিনার আমলে নির্বাচন ব্যবস্থার ধ্বংস, বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব, বিরোধী দল দমনে রাষ্ট্রীয় শক্তির ব্যবহার—সব মিলিয়ে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের চিত্রই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।এই সময় শেখ হাসিনার সরকার একের পর এক নির্বাচনের নামে ভোটবিহীন নির্বাচন আয়োজন করেছে।
২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল কার্যত একতরফা। ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন তুলেছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনেও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে বাইরে রেখে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা ছিল স্পষ্ট।কিন্তু রাজনীতি কেবল প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের খেলা নয়। জনগণের মন জয় না করতে পারলে রাষ্ট্রক্ষমতা শেষ পর্যন্ত ফাঁপা হয়ে পড়ে।আজ সেই বাস্তবতা দৃশ্যমান।
১৭ বছর পর তারেক রহমানের দেশে ফেরার খবরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে আলোড়ন তৈরি হয়েছে, তা প্রমাণ করে—জনগণের রাজনীতিতে তার উপস্থিতি এখনও কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপির তৃণমূল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের প্রত্যাশা ও আবেগ কাজ করছে। দীর্ঘদিন যাকে “পলাতক”, “অযোগ্য”, “ভীত” বলে প্রচার করা হয়েছিল, সেই নেতাই আজ ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দেশে ফিরছেন।আর প্রশ্ন উঠছে—যিনি বারবার বলতেন “দেশে এসে দেখাও”,আজ তিনি কোথায়?
আজ শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়েই জনমনে প্রশ্ন। রাজনৈতিকভাবে তিনি ক্রমেই বিচ্ছিন্ন, জনসমর্থন হারানো, আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্কিত। দীর্ঘ শাসনের ক্লান্তি, দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, মানবাধিকার লঙ্ঘন—সব মিলিয়ে তার শাসন আজ জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নয়, বরং প্রশ্নবিদ্ধ।তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন তাই শুধু একজন নেতার ফেরা নয়—এটি অহংকারের রাজনীতির বিরুদ্ধে সময়ের প্রতিশোধ। এটি প্রমাণ করে, দমন-পীড়ন দিয়ে ইতিহাসকে থামানো যায় না। সত্যকে নির্বাসনে পাঠানো যায়, কিন্তু মুছে ফেলা যায় না।
রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু জনগণের স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী। যারা দম্ভ নিয়ে ইতিহাসের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, শেষ পর্যন্ত তারাই ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়ায়।জনগণের প্রশ্ন শেখ হাসিনা কোথায়? আজ তারেক রহমান দেশে ফিরছেন বীরের ভেসে।