ভয়াবহ আগুন পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে রাজধানীর কড়াইল বস্তি। দেড় হাজার পরিবার হারিয়েছে তাদের মাথা গোজার ঠাঁই। সবার বুকজুড়ে এখন হাহাকার। পুনর্বাসন হওয়া পর্যন্ত কোথায় তাদের ঠিকানা? দিন যেমন তেমন, রাত নামলে ক্ষতিগ্রস্ত দেড় হাজার পরিবারের সদস্যরা ঘুমাবে কোথায়, এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারোই।
মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) বিকেল সোয়া ৫টার দিকে মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট টানা পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় ভয়াবহ সে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু তার আগেই পুড়ে ভস্ম দেড় হাজার কাঁচা ঘর। ফলে একমাত্র মাথা গোজার ঠাঁই হারিয়ে শত শত হতদরিদ্র মানুষকে গতকাল থেকে থাকতে হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে।
অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন লাভলী বেগম। সাত বছর ধরে কড়াইল বস্তিতে বসবাস তার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে লাইলী বললেন, ‘আগুনে আমাদের সব হারিয়েছি। কিস্তিতে কেনা জিনিস, কিছু জমানো টাকা, কাপড় সব কিছু পুড়ে গেছে। বাচ্চাদের নিয়ে ঘুমাব কোথায় জানি না। আমরা সাহায্য চাই, পোলাপান নিয়ে থাকার জন্য নিরাপদ একটু আশ্রয় চাই।’
লাইলী বেগমের স্বামী পেশায় ভ্যানচালক। নাম মোহসিন আলী। তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার সময় আমি ভাড়া নিয়ে যাচ্ছিলাম। খবর পেয়ে সব ফেলে দৌড়ে এলাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে আর কিছুই করতে পারিনি। আগুনে আমাদের ঘর, টাকাপয়সা, জামাকাপড় সবই শেষ। এখন বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে থাকব কোথায়, শীতের মধ্যে ঘুমাব কোথায়, কিছুই জানি না।’
মাস দুয়েক আগে কড়াইল বস্তিতে উঠেছেন দিনমজুর শামসুল ইসলাম। আগুনে সব হারিয়েছেন তিনিও। শামসুল বলেন, ‘আগুনে আমার নতুন জিনিসপত্র সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুন এত তীব্র ছিল যে আমরা কোনো জিনিসই রক্ষা করতে পারিনি। চারিদিক ধোঁয়া আর আগুনে ঘিরে আমাদের বের হতে অনেক কষ্ট হয়েছে।’
সারারাত কীভাবে কাটালেন জানতে চাইলে এই দিনমজুর বলেন, ‘আমরা বড় মানুষ, আমাদের নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। সমস্যা হচ্ছে বাচ্চাদের নিয়ে। তারা তার ফুফুর সঙ্গে খামারবাড়ি মাঠের পূর্ব পাশে এক জায়গায় বিছানা করে শুয়ে ছিল। এভাবেই রাত কেটেছে তাদের।’
এদিকে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতে খাবার এবং পানির সংকটও দেখা দিয়েছে। তবে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি এবং জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীরা তাদের অস্থায়ীভাবে খাবার ও পানি পৌঁছে দিচ্ছে। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম। ফলে অনেক পরিবারের নারী-শিশুদের খালি পেটেই থাকতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে ফরহাদ হোসেন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘এখানে অনেকগুলো ঘর পুড়েছে। অন্তত দুই হাজার লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছে। এত মানুষের জন্য তো কিছু করা যায় না। তারপরও আমরা যতটুকু পারছি করছি। রাতে জামায়াতের ডা. খালিদ সাহেব খাবার-পানি দিয়েছেন। কিছু সামাজিক সংগঠনও কাজ করছে।’
কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বিপুলসংখ্যক ঘর পুড়ে বহু পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মঙ্গলবারের (২৫ নভেম্বর) এ ঘটনায় তিনি আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কড়াইল বস্তির অগ্নিকাণ্ডে যেসব পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছেন, তাদের দুঃখ-কষ্ট আমাদের সকলের বেদনার। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সরকার প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা নিশ্চিত করবে।’ পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান করে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনাও দেন।
কড়াইল বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনাও জানিয়েছেন। মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) রাতে এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ জানান তিনি। ক্ষতিগ্রস্তরা এই কঠিন সময়ে ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন বলেও দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারেক রহমান।
প্রসঙ্গত, প্রতি বছরই কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগে। এসব কি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি নেপথ্যে রয়েছে অন্য কারণ, এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন। বস্তিবাসীদের উচ্ছেদে এমন ঘটনা ইচ্ছাকৃতই বারবার ঘটানো হয় কি না, ওঠে এমন প্রশ্নও। কিন্তু বস্তির আগুনে পোড়া ঘরগুলোর মতো এই প্রশ্নও একসময় ছাই হয়ে মাটিতে মিশে যায়, উত্তর মেলে না। খবর : ঢাকা মেইল