সব ধরনের সেবায় মাশুল বাড়িয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরের সেবায় গড়ে ৪১ শতাংশ মাশুল বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে কনটেইনার পরিবহনে মাশুল বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। বর্ধিত এ মাশুল রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকখাতের জন্য ‘অশনিসংকেত’ বলছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা।
পোশাক শিল্প মালিকরা বাড়তি মাশুলের জন্য দুষছেন বন্দর কর্তৃপক্ষকে। প্রস্তাবিত ট্যারিফ নিয়ে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠকে ব্যবসায়ীদের দেওয়া পরামর্শ তোয়াক্কা করা হয়নি বলে অভিযোগ করেন রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা।
রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান সই করা এক প্রজ্ঞাপনে এ গেজেট প্রকাশিত হয়। ঘোষিত গেজেট অনুযায়ী সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) থেকে নতুন মাশুল কার্যকর হয়েছে।
বন্দরেরর বড় অংশের কাজ কনটেইনার পরিবহন। মাশুলও বেশি বাড়ানো হয়েছে কনটেইনার পরিবহনে। ঘোষিত গেজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, পণ্যভর্তি প্রতি টিইইউস (২০ ফুট একক) কনটেইনারে বর্তমানে গড়ে মাশুল দিতে হবে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা, যা আগে ছিল কনটেইনারপ্রতি ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা। এতে নতুন গেজেট অনুযায়ী কনটেইনারপ্রতি গড়ে ৪ হাজার ৩৯৫ টাকা বাড়তি গুনতে হবে বন্দর ব্যবহারকারীদের। ২০ ফুটের একেকটি কনটেইনারে গড়ে ৩৭ শতাংশ মাশুল বাড়ানো হয়েছে।
গেজেট প্রকাশের আগে ২৫ আগস্ট বন্দরের সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে মন্ত্রণালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগে. (অব.) সাখাওয়াত হোসেন সভাপতিত্ব করেন। তবে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই ওই বৈঠক শেষ হয়। বৈঠকে ব্যবসায়ীদের পরামর্শ ছিল মাশুল বাড়াতে হলে অনধিক ১০ শতাংশ বাড়াতে পারে বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু রোববার প্রকাশিত গেজেটে প্রস্তাবনা অনুসারেই সব ধরনের মাশুল বাড়ানো হয়। এতে উপদেষ্টার সঙ্গে হওয়া বৈঠকের ইতিবাচক কোনো প্রভাব ঘোষিত গেজেটে পড়েনি বলে দাবি রপ্তানিকারকদের।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ চট্টগ্রামের পরিচালক এবং এইচকেসি অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে সরকারের অথরিটিগুলো কারা চালাচ্ছেন আমরা বুঝতে পারছি না। যেভাবে ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে, সেভাবে রপ্তানি তো বাড়ছে না।’
আমাদের রপ্তানিখাতের বড় অংশ তৈরি পোশাক রপ্তানি। যেভাবে আন্তর্জাতিকভাবে তৈরি পোশাকখাতে আমাদের প্রতিযোগী বাড়ছে, সে বিষয়টি কি বন্দর বিবেচনায় নিয়েছে? এখন যেহেতু আমাদের ব্যবসাই নেই, সেখানে বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানো নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই।- বিজিএমইএ চট্টগ্রামের পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী
তিনি বলেন, ‘আমাদের রপ্তানিখাতের বড় অংশ তৈরি পোশাক রপ্তানি। যেভাবে আন্তর্জাতিকভাবে তৈরি পোশাকখাতে আমাদের প্রতিযোগী বাড়ছে, সে বিষয়টি কি বন্দর বিবেচনায় নিয়েছে? এখন যেহেতু আমাদের ব্যবসাই নেই, সেখানে বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানো নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই।’
পোশাকখাতে বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানোর নেতিবাচক প্রভাব আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি। বলেন, ‘জানুয়ারি থেকে আমাদের পোশাকখাত নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কারণ, আমেরিকা যেভাবে ভারতের ওপর ট্যারিফ আরোপ করেছে, তাতে ভারত বসে থাকবে না। তাদের (ভারত) ব্যবসায়ীরা ইউরোপের দিকে নজর বাড়াচ্ছে। পোশাকখাতে ইউরোপে আমাদের বড় ব্যবসা রয়েছে। বায়াররা যদি ভারতমুখী হন, তাহলে আমাদের রপ্তানিখাত আরও ঝুঁকিতে পড়বে।’
তিনি বলেন, ‘ঘোষিত ট্যারিফ পুনর্বিবেচনা করার জন্য আমরা বন্দরকে চিঠি দিয়েছি। এখন বন্দরের উচিত বাংলাদেশের অর্থনীতি গতিশীল রাখতে এ ট্যারিফ বিবেচনা করা। পোশাকখাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশের পুরো অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
চট্টগ্রাম বন্দর তো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তারপরেও বিগত বছরগুলোতে বন্দর তো কখনোই লোকসান দেয়নি। তারা ধারাবাহিক লাভ করেছে। তাতে এ মুহূর্তে গড়ে প্রায় ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।- বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম
বন্দরের বর্ধিত ট্যারিফ পুনর্বিবেচনা করার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর তো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তারপরেও বিগত বছরগুলোতে বন্দর তো কখনোই লোকসান দেয়নি। তারা ধারাবাহিক লাভ করেছে। তাতে এ মুহূর্তে গড়ে প্রায় ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।’
গত ২৫ আগস্ট বৈঠকে ব্যবসায়ীদের সামনে ট্যারিফ বাড়ানো নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো যুক্তি দিতে পারেননি উল্লেখ করে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আমরা ট্যারিফ বাড়ানো নিয়ে উপদেষ্টা মহোদয়ের সামনে বলেছি, যে হারে প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটা যুক্তিযুক্ত নয়। এখন এ ট্যারিফ বাড়ানোর কারণে তৈরি পোশাকখাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। কারণ বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার তৈরি পোশাকখাত। একদিকে আমাদের উৎপাদন খরচ বাড়লো, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমতে থাকবে।’
নতুন বর্ধিত ট্যারিফ কোনোভাবেই কাম্য নয় দাবি করে ঘোষিত গেজেট পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেন এ ব্যবসায়ী নেতা।